Tuesday, January 08, 2008

উইম্পির চিকেন ব্রোস্ট, মাধুরী দীক্ষিত এবং একটি ট্র্যাজিডি

আমার মতি মামা। বয়সে আমার প্রায় সমবয়সী। হাতে গুণে আড়াই বছরের বড়। সম্পর্কের দূরত্ব তাই হেরে গেছে বয়সের কাছে। আমরা বরাবরই বন্ধু সুলভ। মামা-ভাগ্নে সম্পর্কের বেড়াজালে আমরা একে অপরকে আবদ্ধ করে রাখিনি কখনোই। তাই আমাদের মধ্যে চলে এলাকার গন্ডি পেরিয়ে বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে দুজনেই গলাগলি করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা মামার তৎকালীন প্রেমিকার জন্য। মামা নীপোবনে প্রেমিকার সৌন্দর্য বয়ান করে আর আমি দূর থেকে পাহারা দেই। বিনিময়ে পাই স্কুল ফাঁকি দেবার অপরাধে বাড়িতে না-নালিশীর অঙ্গীকার। উপরি হিসেবে জুটে বাবুলের দোকানে ভরপেট ডাল-ভাজি সহযোগে পরোটা খাওয়ার সৌভাগ্য।

মতি মামার ভাগ্নে হিসেবে তাঁর বান্ধবী মহলে আমার খাতির ছিলো এক্সট্রা। মন্দ লোকে বলে, মামা নাকি এক সঙ্গে কয়েকটা প্রেম চালায় প্যারালাল। বান্ধবী মহলের প্রশ্নবাণে আমি বলি, 'মতি মামার মতো লোকই হয় না। সে তো কেবল আপনার নামই আমার কাছে জঁপে দিবস-রাত্রি!'মামার প্রেমিকা খোশ, মামাও খোশ, আমার পেট ও পিঠ দুইই খোশ!

দিন যায়, রাত ঘনিয়ে আসে। ঘুরে মাস যায়, মাস ঘুরে পেরোয় বছর। আমাদের পদদলনের হাত থেকে রক্ষা পায় গ্রাম। দুরুম দারুম চারণ শুরু হয় রাজধানীর বুকে। আগে যে মতি মামা দাঁড়িয়ে থাকতো বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে, এখন সে অপেক্ষা করে ইডেনের সামনে। আর আমি যে ছাপোষা ছিলাম, সেই ছাপোষাই থেকে যাই। পাহারাদার! তবে দুষ্টুমীতে সামান্য শিল্পের ছোঁয়া লেগেছে। মামার বান্ধবীদের কেবল মিষ্ট কথাতেই তুষ্ট রাখি না বরং সাথে প্রোক্সিও দেই। মামাও নির্দ্বিধায় চালিয়ে যান প্যারালাল ডেটিং।

মতি মামা এখন আর আগের মতো পকেটউদার নন। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পকেট খরচ পান হিসাব করে। আমার পেছনে তাই প্রতিটি টাকা খরচ করার আগে অন্তত আড়াইবার ভাবেন টাকাটা তিনি জলে ফেলছেন কী না। মন্দ লোকে কিছু না বললেও আমি ঠিকই বলি, 'মামা তুমি কিপ্টা হয়ে গেছো। নিজের ভাগ্নেকে কয়েকটা টাকা দিবে তাও ভাবতে হয় তোমার। ছিঃ, মামা ছিঃ। তুমি মামা নামের কলঙ্ক। তোমার টাকা ইন্দুরে খাবে, কেঁচো খাবে, কুত্তা বিলাই সবে খাবে, কিন্তু আমি খাবো না! যাও চাইনা তোমার টাকা'।

মতি মামা হুঙ্কার দিয়ে বলেন, 'অ্যাঁএএ, যা ভাগ হতচ্ছারা। পরশুদিন যে চিঠিটা নাসরিনকে দিতে বললাম, দিয়েতো এলি শারমিনকে। তারওপর শুনলাম তোকে নাকি আজকাল আমার বান্ধবীদের সঙ্গেই বেশিরভাগ দেখা যায়। কিছু বুঝিনা আমি মনে করেছিস বদমাশ। মামার উপর বাটপারী আবার দিস হুমকি! দুধ কলা খাইয়ে আমি কালো সাপ পুষেছি এতোদিন'।

মামার মেজাজ নবমে অনুধাবন করে মানে মানে কেটে পড়লাম তখন। পাছে কেঁচো খুড়তে গিয়ে মামার হাতে অজগরের লেজটি এসে পরে! দু'দিন পর অবশ্য মামা নিজেই 'মিটমাট' করতে এলেন। আরে শোন, 'তুই পোলাপান মানুষ, টাকাতো তুই চাইতেই পারিস। কি জানিস, মেজাজটা ভালো ছিলো নারে। বুঝিসইতো তুই সব!'আমি মাথা নাড়ি, এবং উপলব্ধি কারি- মামার নোঙ্গর নতুন ঘাটে পড়ার অপেক্ষায়!

- চল তোকে উইম্পিতে খাওয়াবো।

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি না। মামার খোঁচানীতে অবশেষে এমটিভিতে 'মাধুরী দীক্ষিত - স্পেশাল মোমেন্টস' রেখেও উঠতে হয়। গন্তব্যঃ কামাল আতাতুর্ক এ্যাভেনিউ।

এখানে সামান্য কথা বলে রাখি। বিবাহের পাত্রী হিসেবে মামা এবং আমি- উভয়ের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে যার অবস্থান সে মাধুরী দীক্ষিত। মামা মৃত্যুর পর নরকে যেতেও রাজী কারণ মাধুরীর স্থান হবে নিঃসন্দেহে সেখানে। ইহলোকে না পেলেও পরলোকে নরকবাসী হয়েও মামার মাধুরীকে চাই। মামার বহুবালিকা গমনে এই থিয়োরিটাই কাজ করে বলে জানি। সবার মাঝেই মাধুরীকে খোঁজেন তিনি। না পেয়ে হতাশ হয়ে ষড়ঋতুর দেশের আমার মতি মামা ঋতুর মতোই প্রতি দু'মাস অন্তর অন্তর বান্ধবী পাল্টান। আমি অবশ্য এতোটা না। 'থাকতে যদি না পাই তারে, চাইনা মরিলে...' গানটা ঘোরে আমার গলায়, এর বেশী কিছু না।

উইম্পিতে চিকেন ব্রোস্ট, মিডিয়াম আলুভাজা আর বড় কোকের বোতলকে সাক্ষী রেখে আমাদের মাধুরী বন্দনা জমে ওঠে। তেজাব থেকে মাধুরী কী করে উঠে এলো আজকের অবস্থানে মামা আমাকে এক এক করে বুঝান। দয়াবান-এ 'কামিনা' বিনোদ খান্না কিরমন দয়াহীনের মতো মাধুরীর ঠোঁটগুলোকে নিজের সম্পত্তি মনে করেছে এই শুনে আমি নিজেও খান্নাকে সামনে পেলে বিন্নির খই বানানোর পরিকল্পনা করি মনে মনে। সয়লাব-এ হামকো আজকাল হ্যায় ইন্তেজার গানে নোলক পরা মাধুরীর প্রতিটা উন্মাদনা জাগানো অঙ্গভঙীর পুংখানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন মতি মামা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি আর ভিজুয়ালাইজ করি। আহা, যদি একটাবার জ্যাকি শ্রফ, আদিত্য পাঞ্চেলী বা অনিল কাপুর হতে পারতাম কিংবা নিদেনপক্ষে মকবুল ফিদাই যদি হতাম! তাহলেও তো গজগামিনী নিয়ে গুমগুম রবে মেঘ হয়ে ঝরে পড়তে পারতাম সমগ্র মাধুরীতে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে।

মামাকে হঠাৎ চুপ করতে দেখে ব্রোস্ট রেখে কোলায় মুখ রাখি আমি। মামার দৃষ্টি ফলো করতেই দেখতে পাই রোদচশমা পরিহিতা কোন এক বিংশা কিংবা একবিংশা তরুনীকে। 'হুমম, উইম্পিতে তাইলে এই জিনিষও আসে'! মামার সোৎসাহো জিজ্ঞাসা। আমি কিছু বলার আগেই মামা আবার শুরু করে, 'মালডা দেখতে একেবারে মাধুরীর ক্লোন রে। কোমরটা একদম হুবহু।'উৎসাহের আতিশয্যে মামা তরুনীর অন্যান্য অঙ্গ নিয়েও এমন সব মন্তব্য করেন যা শুনলে যে কেউ তার সম্পর্কে বাজে একটা ধারনা করে বসবে। আমি মতি মামাকে চিনি বলেই বুঝতে পারি, একটা তুলনায়ও তার খারাপ কোন ইঙ্গিত ছিলো না। বহুকাল পরে নিজের স্বপ্নের সাথে বাস্তবের মিলে যাওয়ায় বোধকরি এই আতিশয্য।

উইম্পির সেই ঘটনার পর থেকে মতি মামা কেমন জানি বদলে গেলেন। চলাফেরা, চলন-বলন সবকিছুতেই। কয়েকদিন আমাকে ফাও ফাও উইম্পিতে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেনও। এদিক ওদিক চাওয়া চাওয়ি করলেন। মাধুরীকে নিয়ে আমার জ্ঞানসম্ভার বর্ধিত করলেন। এভাবেই চলে গেলো দিনগুলো। মামার বান্ধবীদের সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পেয়ে একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে গেলো এক সময়।

এর পরের ঘটনায় যাবার জন্য আমরা ফাস্ট ফরোয়ার্ড করবো এখন। এবারের ঘটনা কয়েক বছর পরের।

মতি মামার বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। বড় মামা তার কলিগের মাধ্যমে দারুণ এক পাত্রীর সন্ধান পেলেন। মেয়ে ডাক্তার, দেখতে শুনতেও চমৎকার। সিলেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে স্কয়ার হাসপাতালে চাকরি করছে। মেয়ের পরিবার পাত্র হিসেবে চায় ইঞ্জিনিয়ার, যার মানে মতি মামা একেবারে মোস্ট এপ্রোপ্রিয়েট ব্যাচেলর। পরিবার টু পরিবার কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো। কয়েকদফা দেখাদেখিও শেষ। উভয়পক্ষের ই উভয়পক্ষকে পছন্দ। এখন বাকি ছেলে ও মেয়ে উভয়ের কথা সাক্ষাৎ।

ভেন্যু ঠিক করা হলো, উইম্পি, গুলশান। পাত্রের সঙ্গে থাকবে তার ভাগিনা, পাত্রীর সঙ্গে তার মেজো বোন। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা হাজির। মামা ঘামছেন দরদর করে। 'ঐ মর্কট, আমার পাশে পাশেই থাকিস। দেখিস আমাকে একা ফেলে যাসনে যেনো!'আমি হাসিতে আশ্বস্ত করি। 'তোমার তো কূল হলো মামা, এবার তো নিজের জন্যও ভাবতে হয় আমার। জীবনটাতো গেলো তোমার পেছনেই।'

'হতোভাগা শাখামৃগটা বলে কি! আরে, বলি আমি না তোর মামা। লজ্জা করে না মামার মুখে মুখে ফালতু সব কথা বলতে। পাঁজি কোথাকার।'

কি একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। ওরা এসে গেছে। মেয়ের মেজো বোন এলেন, নিজের পরিচয় দিলেন। মামা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন, আমিও। মেজো বোন বসলেন, বসলেন লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখা মামাও। তাদের ফলো করলাম আমি। কিন্তু পাত্রী বসছে না। দেখার জন্য আমি মুখ তুলে তাকালাম এবং তারপর হিম হয়ে গেলাম। আমার হবু মামীর মুখ লাল। লাজে রাঙা হয় নববধূর মুখ। কিন্তু এ রাঙা লাজের নয়, ক্ষোভের। পরের ঘটনাগুলো ঘটে গেলো বিদ্যুৎগতিতে। আশে পাশের টেবিলে যারা বসেছিলেন তারা পরিষ্কার না শুনতে পেলেও মোটামুটি শিওর হলেন ঘাপলা একটা হয়েছে। তারা চলে যাবার পর বিধ্বস্ত মামাকে শুধু বললাম, 'সেদিন ওরকম আপত্তিজনক কথা গুলো না করলেও পারতে মামা। তাহলে অন্তত আমাকে কেউ 'লম্পট'এর ভাগ্নে বলতো না'। মামার কোন উত্তর আমার কানে এলো না, অস্পষ্ট করে যা শুনলাম তা একটি দীর্ঘশ্বাস।

উইম্পি ঘটনার দু'মাসের মাথায় মামা সেই যে দেশ ছাড়লেন তো ছাড়লেনই, আজোবধি আর ফেরেন নি।

সর্বশেষ আপডেটঃ

* মামার সংসার হয়েছে। আমার বিদেশিনী মামী খুব মায়াবি। এক সন্তানের গর্বিত পিতা এখন মতি মামা।
* আমার বিয়ের কথা-বার্তা চলছে। আমরা একে অপরকে অনেকদিন ধরেই চিনি। ও দেখতে হুবহু মাধুরীর ক্লোন। পেশায় ডাক্তার!

***************************************
লেখাটি হাজারদুয়ারীর বিজয়, বর্ষ- বিদায় এবং বরণ সংখ্যার দখিনা দুয়ারে প্রকাশিত।
***************************************

No comments: