Monday, February 25, 2008

হাত বাড়িয়ে দাও...

দেশে থাকাকালীন ছাদের কার্ণিশে উবু হয়ে সিগারেট ধরানোটা কখনোই হয়নি। বারান্দার রেলিঙেও না। বিদেশের বাড়িতে ছাদ নামক জায়গাটির বড়ই অভাব। রাতের বেলা হঠাৎ একাকীত্ব গলাটিপে ধরলে একটু পায়চারী করে তা দূর করার কোন পথই খোলা রাখেনি এখানকার ছাদের নকশাকারীরা।

ভাগ্যক্রমে এখন যেখানে থাকি সেখানে এক চিলতে ছাদ রাখা আছে আমার মতো বিষাদগ্রস্তদের জন্য। একটা টেবিলের পাশে কয়েকটা বেতের চেয়ারও রাখা আছে সেখানে। পেট সমান উঁচু গ্রীলের ঠিক ওপাশেই পাথরের টুকরো ফেলা চওড়া একটা শেড। এটাই আমার বিষণ্ণতাদূরীকরণের উদ্যান, নগ্ন আকাশের নিচে ধূমপানের এক স্বতস্ফুর্ত অভয়ারণ্য।

চারতলায় রাওখারদের টিভি রুম পেরিয়ে পাশের কাঁচের দরোজা খুলে বেরিয়ে পড়লেই মেলে মুক্তির আনন্দ!

ছাদ থেকে সন্ধ্যার আলোতে মেকেনহাইম ইন্ডাস্ট্রী পার্কের হলুদ বাতির সারিগুলো দেখে উপর থেকে রাতের বেলার এথেন্সকে মনে হয়। হাতের বাঁ দিকে, একটু দূরে, লোকালয় ক্রমশঃ উঁচু হতে হতে বিরাট পাহাড়ের আদল। তার চূড়ায় সন্ধ্যা বেলায় আলো জ্বলে একমাত্র চার্চের মাস্তুলে। ডানদিকে ঘনবসতি লোকালয় ডুইসডর্ফ ছাড়িয়ে ব্রুজারবেয়ার্গ। ঐদিকে তাকাই না, মন আরও বিষণ্ণ হয়। ইট-কাঠ-পরিবর্গের শহর দেখতে ভালো লাগেনা এই সময়টায়।

বসন্তের আগমনী বার্তা প্রকৃতি পেয়ে গেছে আগেভাগেই। নতুন পাতা এখনি জাগেনি গাছে। মার্চের ২০ তারিখে কাগজে-কলমে বসন্ত শুরু হবে। তবে পাখিরা গাইছে এখন থেকেই। ছাদের রেলিঙে কনুই ঠেকিয়ে উপুর হয়ে পাখির মুষলধারে কিচিরমিচির শুনতে শুনতে সিগারেটে চুমুক দিয়ে সিদ্ধান্তটা ফাইনালাইজ করার একটা তাগিদ এলো ভেতরে। তাগিদের সাথে সাথে একটা গানের লাইনও মনে এলো, 'সময় হয়েছে ফিরে যাবার / মন কেনো যেতে চায় না!'

************************
শিরোনামের জন্য কৃতজ্ঞতা রইলো এই গানটার প্রতি
************************

Saturday, February 23, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০৩

গত কয়েক বছর ধরে একুশে ফেব্রুয়ারী আমার মনে থাকে অন্য আরেকটা কারণে।নিরানব্বই এর একুশে ফেব্রুয়ারী একটা বৌভাত হয়ে ফিরছিলাম। পরের দিন বৃটিশ কাউন্সিলে আংরেজী পরীক্ষা সিস্টেম আয়ত্বের নিরস জিনিষ গিলতে হবে বিরস বদনে, সরস জেনি'র পাশে বসে!
আজকে ঘুম ভেঙেছে দেখে ছোট ভাই জিজ্ঞেস করলো দিনটা মনে আছে কি না! অনেক ভেবেও মনে করতে পারিনি আজকের দিনটার শানে নুযুল কী!

মেসেঞ্জারে পরিচিত একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। কথার কথা বলতে কেবল প্যাচানি আর খোঁচানি। এই হাওয়াসন্তানের সঙ্গে প্রথম সাহস করে দেখা করতে যাই হিলসডেইল, বুকে বিশাল সাহস সঞ্চয় করে। অষুধের দোকানে ঢুকে দেখেই বুঝতে পারি কোনটা সে! সঞ্চিত সাহস ফুরুৎ করে সব বেরিয়ে গেলে বুঝতে পারি কথা বলার শক্তিও খুইয়েছে শরীর। কোনো রকমে পাশে সরে এসে বরফঠান্ডা ফাউন্টেন থেকে ঢকঢক করে কয়েক গেলাস শীতল পানি গিলি। সেদিনটাকে ক্যালেন্ডারে কোথাও ফেললে সেটা দেখাবে ফেব্রুয়ারীর ২২ তারিখেরই আশে পাশে কোথাও। কিন্তু সেটাও পূর্বোক্ত ঘটনায় ধর্তব্য না।

বারউড স্কুলের বৈশাখী মেলায় বটগাছের তলে লাল পাড়- সাদা জমিনের শাড়িতে পুতুল পুতুল মুখ করে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামতে দেখেছি। হাতে টিস্যু নিয়ে সামনে ধরে দাঁড়ানো হয় নি। ফেব্রুয়ারীর সাহসের অভাবটা এখানেও অনুভূত হয়েছিলো আগুনভাবে। এখনো চোখের সামনে থেকে বটগাছের ছায়ায় দাঁড়ানো সে মূর্তিটা সরে না!

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA


একটা গানের জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর করছে সেই কখন থেকে, ব্রেক দিয়ে দিয়ে। শর্ত জুড়ে দিয়েছি বলে গোল টেবিলে বসে নেগোসিয়েশন করছে। একেকটা বার্তায় যখন চোখের ডান কোণের কিছুটা জায়গা হলদে হয়ে ওঠে, কানের কাছে মাউথ অর্গানটা যখন বেজে ওঠে, তখন আমিও ২২ ফেব্রুয়ারীর কারণটা তালাশ করতে একবার বৌ-ভাত, একবার ঢাকা, একবার হিলসডেইলের সেই ওষুধের দোকান আরেকবার মেলা মাঠের সেই বটগাছটার নিচে চলে যাই- এক দৌঁড়ে!

Tuesday, February 19, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০২

বিভূঁইয়ে পাঞ্জাবি পরার হ্যাপা অনেক। উপলক্ষই পাওয়া দুষ্কর পাঞ্জাবি পরিধানের। আবার উপলক্ষ পেলেও আবহাওয়া লক্ষ্য করা মস্ত এক ফ্যাক্টর। ঝলমলে, গনগনে দিন হলে কোন কথা নেই, কিন্তু যদি হয় মাঘ মাসের কোন একটা সময়ে! তাহলে শীতে বাঘ তাড়াতে তাড়াতে ভানু সাহেব তার দুইখান কথা না বলে থাকতেই পারবেন না!

পুজার দাওয়াত ছিলো অনেক আগে থেকেই। ভুলেও গিয়েছিলাম। হঠাৎই একজন জানালো যাবো কীনা। আমি পারতঃপক্ষে এড়িয়ে চলতে চাই, কিন্তু এবার পাঞ্জাবি পরার লোভের পাশাপাশি আরেকটা জরুরী তাগিদে যেতে হলো বৈকি! ঘটনাটা খুলেই বলি তাহলে-

ছোটভাই দেশ থেকে আসার পর থেকেই কেমন মনমরা থাকে। চাপা স্বভাবের মানুষ, প্রকাশ না করলেও ঠিকই বুঝি দেশ থেকে আসার পরের সিনড্রোমে ভুগছে। খুব খারাপ জিনিষ এটা। চান্স পেলেই বাড়ির গল্প করছে, ঢাকায় ল্যান্ডিং থেকে ফিরতি ফ্লাইটে ওঠার আগ পর্যন্ত সব ঘটনার পুংখানুপুঙ্খ বয়ান করে ফেলছে সুযোগটি পেলেই। মা বলছিলো, আসার আগে নাকি অন্যবাড়ি গিয়ে কেঁদেছে পাছে মা আসতে দিবে না এই ভয়ে। আমাকে ক্ষণে ক্ষনেই তাগাড়া দিচ্ছে দেশে চলে যেতে।

যাইহোক, তার বাংলাদেশ ভ্রমন পরবর্তী সিনড্রোম কাটাতেই পুজোতে যাওয়া। পুজো তো না ঠিক, পুজোর অনুষ্ঠান। আমি যেতেই দেখা-সাক্ষাত-কোলাকোলি শেষে লুচি খাওয়ার আমন্ত্রন। 'তোমার ভাই এসেছে শুনলাম...'- কয়েকজনের সপ্রতিভ জিজ্ঞাসা। কৌতূহল মেটাই অঙুলি যথাস্থানে নির্দেশ করে। ভাবীরা খাওয়া তুলে দিলো, আমার স্বাস্থ্যের অবনতির কথা মনে করিয়ে দিলো, অনেকদিন বাদে দেখা- খানিক হাপিত্যেশ হলো। এবং অবশেষে পেটপুরে ডাল-সব্জি দিয়ে অগুণতি লুচি খাওয়া হলো।

এবার গানাবাজনা হলো। পেছনে দাঁড়িয়ে যতো রকম দুষ্টামী করা যায় করা হচ্ছিলো। সামনে বসা আধা-বাঙালী তিনজন ললনার সঙ্গেও চোখাচোখি হলো, ড্যাম কেয়ার ভাব দেখানো হলো (ছোট ভাই আছে যে সাথে, তাছাড়া আজকে মিশনতো ভিন্ন!), দল বেঁধে বাইরে গিয়ে বিড়ি ফুঁকা হলো, এবং অবশেষে ফেরার পথ ধরা হলো।

একজন কোথাও বসে সময়ক্ষেপণের আহবান জানালো। এবারো রাজী হলাম ছোট ভাইয়ের জন্যই। নির্ধারণ হলো বায়ার্ণের 'সালভাটোরে'। ভালো লাগার মতো একটা জায়গা। যারা বায়ার্ণ দেখেনি তারা অন্তত ঐ ছোট্ট জায়গাটুকুতে বায়ার্ণের আমেজ এবং আবেশ দুই'ই পেতে পারে। বিরাট লিটার মগে এক্সপোর্ট বীয়ার, নানা সাইজের 'পাওলানার'-র গেলাস, বিশাল স্ক্রীণে ফুটবল খেলা, বায়ার্ণের স্কাল্পচারাল ভিউয়ের একপাশে জার্মানীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সালভাটোরে পরিভ্রমন এবং ভালোলাগার মানপত্র, পরিবেশ সব মিলিয়ে চমৎকার একটা জায়গা সময় কাটানোর। ওখানে বসেও বোধ করি বেচারা ছোট ভাই দেশের অলিতে গলিতেই ঘুরে বেরিয়েছে।

বাংলাদেশ ভ্রমনোত্তর এই সিন্ড্রোম কাটাতে খুব শীঘ্রই তার প্রিয় সুইজারল্যান্ডে একটা ট্যুর করা যায় কিনা ভাবছি। আবার এটাও ভাবি পাশের দেশ হল্যান্ডে গেলেও ভালো। ফুলের দেশ, মন ফুরফুরে হবে নিশ্চই, যদিনা জটিল কোন প্রেম রোগ থেকে থাকে। আর আমারও অনেক দিন হলো, হল্যান্ডের ফ্রেশ গঞ্জিকা সেবন করা হয় না।

Sunday, February 17, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০১

বাতি নিভে যাবার আগে যেমন দপ করে জ্বলে ওঠে, তেমনি করে এবারের শীত গত কয়েকদিন ধরে চামড়া, মাংস ভেদ করে সোজা হাড়ে গিয়ে কামড়টা বসাচ্ছে। এটা এমন বিশেষ কিছু না। প্রতিবছরই কিছু না কিছু তুষারপাত হয়, এবার তুষারের দেখা মেলেনি। মাঝ-ফেব্রুয়ারীতে শীতের কামড়টা সামান্য অশ্লীলই হবে, এ আর এমন কী!

একাধারে অনেকক্ষণ একই জিনিষ দেখা কিঞ্চিৎ একঘেয়ে বটে! টানটান উত্তেজনায় ভরা ইংরেজী কোন ছবি হলে সেটা মেনে নেয়া যায় দৈর্ঘ্যের কথা বিবেচনায়। কিন্তু এক্ষেত্রে হিন্দি ছবি প্রায়ই মার খেয়ে যায় আমার কাছে। তিন ঘন্টায় কম করে হলেও সাড়ে পাঁচবার বিরতি নেয়া হয়। 'ইদানিং বাংলা ছবি দেখি'- একথা শুনলে জনগণ তেড়ে আসবেন মেরে ঠান্ডা করে দেবার আশায়, তাই না হয় উহ্যই রাখলাম আমার বাংলা সিনেমাপ্রেম! আর বিয়ের ভিডিও? টেনেটুনে, ফরোয়ার্ড-রিওয়াইন্ড করে কখনোই বোধকরি সিকি ভাগের কোটা ছাড়াতে পারিনি। ব্যতিক্রম ঘটিয়ে দিলো ভাইয়ের বিয়ের ভিডিওটা। এখন পর্যন্ত সোয়া দুইবার দেখা হয়ে গেছে কী না!

একটু ট্রেলার দিই বরং, কী আছে সেখানে।

আমার মা। ভিডিও ক্যামেরার সামনে যাকে মনে হয়েছে পুরা রোবোকপ। হাতে নানা জিনিষ, কণের বাড়ি যাচ্ছেন, জিনিষ বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ঘর থেকে বের হয়েছেন, চলাফেরা করছেন- কিন্তু মুখ একদম বন্ধ আর চোখ? সটান খোলা। নো পলক, নো নড়ানড়ি! বেচারী, এতো পছন্দের পান মুখ ভর্তি করে রেখেও সেটা চিবাতে পারছেন না ক্যামেরাম্যানের ভয়ে!

আমার বাবা। সবচাইতে যার ভিডিও তথা ছবি কম উঠেছে তিনি এই ব্যক্তি। হ্যালীর ধূমকেতুর মতো হঠাৎ নজরে এসে যাওয়া মোবাইল হাতে বাবাকে দেখে ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করতে ভাই জানালো, এটা আব্বার নতুন বাতিক! কারণে অকারণে মোবাইল টেপাটেপি করা। মা এজন্য মহা বিরক্ত। আমি হাসি আর ভাবি, মা'র বিরক্তির কারণই তাহলে বাবার এই বাতিকের পেছনের কারণ!

ভাইয়া। বিয়েটা তারই। বেচারাকে দেখে মনেহয় পুরা পেরেশানীতে পড়ে গেছে। কয়েক জায়গায় দেখলাম খালি চড়কীর মতো ঘুরছে। কণের গায়ে হলুদে যাবার গাড়ি বহরের পাশে এক সুদর্শন যুবক কে দেখে ছোট ভাইকে যেই বললাম, বাহ্ ড্রাইভারটা তো বেশ স্মার্ট। অমনি ছোটভাই হায় হায় করে বলে, আরে ড্রাইভার দেখলা কই? এটাতো ব-বে! (মানে বড় ভাই)

ছোটভাই। হ্যাঁ এ হলো সেই যার জন্মদিনে আপনারা শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন অনেকেই। খুব খুশী হয়েছিলো সেদিন। সবাইকে ফিরতি ধন্যবাদ জানিয়েছে অকাতরে। বিয়েতে মধ্যমণি ছিলো সে-ই। সারা ভিডিও জুড়ে মনে হলো কেবল তাকেই ক্যামেরাম্যান শ্যুট করেছে। একবার কোয়ার্টার প্যান্ট আর কালো টিশার্ট পরে মানির বোতল টানে তো পরের শটে দেখা যায় ভীষণ মাঞ্জা মেরে মেহমান বরণ করছে। ঠিক তার পরের শটেই দেখা যায় কাকে হাত নেড়েনেড়ে কি ডিকটেশন দিচ্ছে। সারাক্ষণই হাসে ব্যাটা। চশমার ভেতর দিয়ে পিটপিট করে তাকায় আর দাঁত বের করে হাসে। হাতে ২৬টা দিন নিয়ে সব কিছু সূচারু ভাবেই সম্পন্ন করে এসেছে, বুঝা যায়। সবার শেষে ভাইয়াকে হলুদ দিতে স্টেজে যেতেই দেখলাম দুজনে পালা করে কেঁদে দিলো। ভাইয়ার কপালে হলুদ ছোঁয়াতেই ভাইয়া কেঁপে উঠে টিস্যুতে চোখ মুছে আর এটা দেখে ছোটভাই সারা শরীর কাঁপিয়ে দুহাতে চোখ ঢেকে স্টেজ থেকে পালালো। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমার দৃষ্টিও খানিকটা ঝাপ্সা মনে হলো। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি কাঁদিনি। কাঁদার মতো এতো নরম আমি মোটেও না।

আমার ভাবী। আমাদের পরিবারে নতুন সংযোজন। পরিবারের সদস্যসংখ্যা পাঁচ থেকে ছয়ে উন্নীত করতে তার ভূমিকা অনেক। যেহেতু তাকে এখনো দেখিনি, তাই তাকে নিয়ে এখনি কিছু লিখছিনা। তুলে রাখলাম পরের বারের জন্য। তবে ফোনে যতটুকু বুঝলাম, আমাদের পরিবারের পারফেক্ট মেম্বার! 'মা তোমাকে অনেক মিস করে। মা'কে কাঁদাতে ভালো লাগে তোমার?' - আমাকে ছুঁড়ে দেয়া প্রশ্নটি ছিলো তার!

Friday, February 08, 2008

ভালোবাসায় প্রত্যাবর্তনের পথ

চোখের সামনে ভোর হচ্ছে। অসাধারণ এক দৃশ্য। একটু আগে কয়েকটা পাখির ডাকও কানে এলো জানালার মোটা কাঁচ ভেদ করে। দিনের শেষের বেলায় ঝাকিয়ে পড়া প্রচন্ড ঠান্ডাটাকে বাদ দিলে আজকেও আশা করা যায় কালকের মতোই ঝলমলে রোদে নেয়ে উঠবে চারদিক। দিনের শুরুটাই দেখুন না কেমন রাঙা, রোদেলা মনে হচ্ছে। শীতের ঘাপ্টি মারা গুমোট স্যাঁতস্যাঁতে বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠতে খিলখিল করে ওঠা রোদের দরকার, দরকার গ্রীষ্মের উষ্ণতার। তার সাথে টুংটাং করে পিয়ানোর সুর বেজে উঠলে আর কিছু লাগে?

রাস্ত পরিষ্কার করার একটা চিঙড়ির মাথার মতো গাড়ি উঁচুনিচু তে ঠেঠেঠেঠে শব্দে ঝাঁকি খেতে খেতে চলে গেলো। অন্যসময় হলে বোধকরি শব্দটা অসহ্য লাগতো, আশ্চর্য- এখন লাগলো না। এই যেমন ধরুন, গেলো রোববারেই তো বেলা ১১টার দিকে ঘুমের ভেতরেই আমার হঠাৎ মনে হলো এ্যালার্ম বাজছে, তাও ভয়ানক জোরে বিভিন্ন ঢুমঢাম শব্দে। কী যন্ত্রণা, আমি তো এ্যালার্ম সেট করে ঘুমাইনি, তাহলে বাজে কোত্থেকে! মোবাইল ধরে টানাটানি করি, উঁহু বাজেনাতো। আরি কী মুশকিল, এই পাগলা শব্দের উৎস কই! টেনশনে রুই মাছের মতো ফোলা ফোলা লাল চোখে জানালা গলে তাকিয়ে দেখি নিচে কার্ণিভাল শোভাযাত্রার অফিশিয়াল স্টার্ট হচ্ছে এখান থেকে। শব্দটা ওদেরই তৈরী। হাতের নানাপদের বাদ্যসরঞ্জামের শব্দ। এই দিনে যে কেউ একটু সকালের আরামের ঘুমটা দিতে পারে সেটা হয়তো তাদের মাথাতেই নেই। প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছিলাম। জানালা কাৎ করে, মুখটা বের করে দিয়ে খাঁটি বাংলায় কয়েকটা আউলা কিসিমের গালি দিয়ে আবার বিছানায় ধপাস।

আগে ধুমধাম সিনেমা দেখার প্ল্যান হতো। ভাষাগত প্রেফারেন্সের কারণে যখন, যেখানে, যেমন খুশী দাঁত কেলিয়ে ঢুকে পড়া যায় না। খোঁজ লাগাতে হয় ভালো সিনেমাটার অরিজিনাল ভার্সন কোথায় চলছে। সবকিছু নিঁখুত, নিপাটে সম্পাদনার ব্যক্তিত্বের শূন্যতা বোধ হয় প্রায়শঃই। অনেকদিন হয় সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয় না। এখন মনেহয় সেই আগ্রহবোধেও খানিকটা ভাটার টান লেগেছে।

এমনি কোন এক বিষণ্ণতা বিদেয় করা গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিলো মিউজিক এন্ড লিরিক্স। খুব আলোচিত সিনেমা না। কিন্তু ঐযে শিরোনামের গানটা থেকে গেলো যে মনে। পিয়ানোর টুংটাং-এ শুরু হয়ে গানটা যখন আমি যা করতে চাই তা হলো, ভালোবাসায় প্রত্যাবর্তনের একটা পথ খুঁজে পেতে চাই- লিরিক্সের এই টানেলটা দিয়ে পাড় হয়, তখন মনে হয় 'ছাইড়া দে আমারে।' পথ যে আমিও খুঁজে পেতে চাই এমন না।
'কোন কনভেনশনাল পথে হাঁটাই বুদ্ধিমানের কাজ না'- কোন এক মহর্ষী জানি বলেছিলো। আমি মহর্ষীর বাণী মানি বলে আপনিও মানবেন তাতো হয় না! গানটা শুনে ভালো লাগলে সবাই পথ খুঁজে পেতে উঠে পড়ে লেগে পড়বেন, কামনা করি। কোন কিছুই ধ্বংস হয় না, রূপান্তরিত হয় কেবল। আপনার ভালোবাসার মেঠো পথটাও রূপান্তরিত হোক পাকা হাইওয়েতে, আর সেই হাইওয়েতে ঢোকার জন্য জ্যামবিহীন শর্টকাট মোটরওয়ে যেনো খুঁজে পান সবাই (যাদের দরকার), তার জন্য শুভকামনা। মনে রাখবেন, যেকোন পথের শুরু এবং শেষ স্টেপটিই হয় ভালোবাসার। মধ্যকার স্টেপগুলো মনে করার বা রাখার দরকার নেই।

Tuesday, February 05, 2008

সময়ের উৎসবে কিছু অন্যসময়ের গল্প

ঠিক করেছি পুরানো কনটাক্টগুলো ঝালিয়ে নেবো এবার। বন্ধু বান্ধবরা সবগুলো দূরে দূরে সরে যাচ্ছে একেকজন ব্যস্ততার অজুহাতে। হঠাৎ ভালো লেগে যাওয়া একজনকে বেশ অনেকদিন বাদে শোনা হলো, অপ্রত্যাশিত ভাবে। নিজের দুনিয়া সাজাতে গিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে স্কয়ারের বিজ্ঞাপনের আদলে স্কয়ারের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে রেখেছে। এখন তাকে হঁটিয়ে নিজেকে সেই জায়গায় বসানোর ধান্ধায় আছি। দেখি গ্রীন সিগনাল পাই কিনা, না পেলেও অসুবিধা নেই। রেড লাইটেও গাড়ি চালানোর অভ্যাস আমার আছে।

বছরখানেক আগেও ফুলি বেগমের সঙ্গে বেশ ভালো যোগাযোগ ছিলো। সপ্তাহান্তে সকালে ফোন করে ঘুম থেকে তুলে আমাকে নাশতা করাতে নিয়ে যেতো ক্যাফে গোয়েটলিশ কিংবা মুনস্টারপ্লাৎসে বেকার সাহেবের দোকানে। আমি ঘুম ঘুম চোখে ঢলতে ঢলতে বাটার ক্রঁসো তে দাঁত বসিয়ে আয়েসী ভঙিতে ধোয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিতাম চুকচুক করে। তার উদ্দেশ্য ছিলো আরও মারাত্নক। আমাকে বিখ্যাত বইয়ের দোকান 'বুফিয়ের'এ নিয়ে গিয়ে সুনসান নীরবতায় বই পড়া এবং পড়ানো। ও আয়েশ করে একটা সোফাতে বসতেই আমি উঠে চলে যেতাম এমন একটা সেকশনে যেখানে সব কামাসূত্রার নানারকম সব সচিত্র বই থরে থরে সাজানো আছে। বিরাট বোদ্ধার মতো এক হাতে থুতনী চেপে আরেক হাতের তর্জনী দিয়ে মলাটের ওপর নজর বুলাতাম, 'কোন বইটা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে'!

আমাকে এদিক-ওদিক খুঁজে না পেয়ে জায়গামতো এসে ফুলি বেশ উঁচু স্বরেই জিজ্ঞেস করতো, 'তুমি এখানে করো কি? দুনিয়ার এতো বিখ্যাত বিখ্যাত সাহিত্য, এতো নামীদামি বই কি তোমার চোখে পড়ে না! ওগুলা রেখে এইসব খাইস্টা জিনিষে কি দেখো।' এখন আমি এই বালিকা কে কি করে বুঝাই যে দুনিয়ার যতো রহস্য, যতো হাংকিপাংকি সবই আছে এই সেকশনে! সে আমার বুঝদার লেকচারের তোয়াক্কা না করে রীতিমতো হিঁচড়ে নিয়ে লাল রঙের একটা সোফায় বসায়, হাতে ধরিয়ে দেয় একটা জিওগ্রাফীর বই। আমি দেড় মিনিটে পুরা একশো ষাট পাতা শেষ করে ফেলে বলি বই শ্যাষ। আমি অন্য সেকশনটা একটু ঘুরে আসি। মিনিট দশেক পরে আবার এই বেরসিক ফুলি আমাকে পাকড়াও করে রসিক সেকশনে এসে। কী ঝামেলা!

সেদিন কথা হচ্ছিলো। বলে তুমি কি ইদানিং খুব বেশি বিড়ি ফুঁকছো না? আমি বলি, কই নাতো। তেমন আর বেশি কই। আগেতো এর সঙ্গে গঞ্জিকাটাও যুক্ত ছিলো, এখন না আমার সোর্সগুলো টার্ণআপ করছে না। শালা পাঠার দল। কই যে ডুব দিলো! শুনে ফুলি বেগম চোখ কপালে তোলে, 'গেছ তুমি'!

আজকে কাজের ওখানে হঠাৎ করেই ভড়াক করে বমি করলাম। তারপর আবার করলাম। এক পশলা কান্না করে, মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতেই আবার বিশাল ধাক্কা। এবং আবার কমোড ভাসানো, চোখের পানি নাকের এক করে সশব্দে আবার কান্না। আমি বমি করতে পারি না, ছোটবেলায় যেমন করে কাঁদতাম, এখনো সেভাবেই কাঁদি। ফুলি বেগমের সাথে দেখা হলে বলে তোমার কপাল 'পেল' হয়ে আছে। বমির কথা বলতেই বলে, সিদ্ধি টানো কেনো? বললাম লেও হালুয়া। ভাত ছাড়া তো আর কিছুই খাই নি, ঈমানে বলি। মনে হলো বিশ্বাস করে নি। না করুক, কার কি!

সন্ধ্যায় এক পুরানো পরিচিতের সঙ্গে দেখা হলো। এক সঙ্গে বিড়ি ফুঁকলাম স্টেশনে হলুদ মার্জিন দিয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া জায়গাটায়। শেষ হতেই আবার ভড়াক। পকেট থেকে পলিথিনটা বের করে সময়মতো জায়গামতো সেট করতে না পারলে প্রেস্টিজ ধরে টান পড়তো। কার্ণিভালের সময়ে যেখানে সেখানে বমিত্যাগ একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার। বেহুঁশ হয়ে লোকজন পাগলা পানি গিলে যে! আমার কষ্টটা লাগে কিছু না গিলেও রাস্তা ঘাটে পলিথিন পকেটে নিয়ে ঘুরতে।

শনিবার রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘরে ফেরার পথে হঠাৎই দেখা হয়ে গেলো ডয়চেভেলের বন্ধুদের সঙ্গে, প্রায় মাস দুয়েক পর। পাকড়াও করে নিয়ে গেলো নতুন পরিচিতা হুমা তার বাসায়। চারজন মিলে গোশত-ডাল-রুটি সাবাড় করে বাদ শায়েরী শ্রবন একসঙ্গে ডিসকো যাবার পালা। অনেক আগে যখন বিশাল এক কাফেলা যেতাম কোলনের শিভাবারে, সেটা ছিলো অন্য সময়। তারপর আর আউটিংয়ে যাওয়া হয়নি। বন-এ তো কোন কালেই নয়। এবার যেতে হলো। দরোজায় বিশাল বপু গার্ড জানিয়ে দিলো কার্ণিভাল পার্টি চলছে ভেতরে। তোমাদের মতো স্যুটেড-বুটেড হয়ে আজকে ঢুকা যাবে না। কস্টিউম পরে আসো। খাইয়া কাম নাই, লও যাইগা। বলে হাঁটা দিলাম। ইউনিভার্সিটির এখানে ব্লোআপ, জায়গাটা খারাপ না। ঢুকে গেলাম চারজনে।

জিঞ্জারএল হাতে নিয়ে বসতেই দেখি মাথায় বাবরি চুল লাগানো বিশাল এক সুদর্শনা আমার পাশের জুটির ফটুক তুলছে। ওখানে একটু ঝুঁকি নিয়ে উঁকি মারতেই ফটোগ্রাফার ললনাটি সুন্দর একপাটি দাঁত বের করে হেসে দিয়ে আমার ফটুক তোলার অনুমতি চাইলো। আমি রাজী হয়ে মডেল হিসেবে চাইলাম তার বান্ধবীকে। বান্ধবী রাজি হয়ে বসে পড়লো ধড়াম করে আমার পায়ের ওপর। আমি কোৎ করে উঠলাম ভরের ঠেলাম। ফটুকে দেখলাম আমি কুঁকড়ে আছি আর ললনা দন্তবিকশিত-আকর্ণ হাসিতে দ্রবীভূত। ওই অবস্থাতেই পলিটিক্স নিয়ে প্যাঁচাল। আমি নানা কথা ঘুরিয়ে পদার্থবিদ্যার ভরের নিত্যতা সূত্র নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমাকে থামিয়ে দেয় জনগণ। পলিটিক্স নিয়ে কথা বলতে আমারও কোন আপত্তি নেই, আগেতো ভরবেগের সূত্রটা জানা উচিৎ!

ললনা সবিনয়ে জানতে চাইলো আমার ফোন নাম্বার রাখতে পারে কিনা। ভারে আমার 'রা সরে না, মাথা ঝাঁকাই। সম্মতি পেয়ে ললনা উঠে যায় তার মুঠোফোন আনতে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আমার করুণতায় বাকী তিনজন খলখল করে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে ব্লোআপে ঠেলাঠেলিতে নিজের পিতৃপ্রদত্ত একটা মাত্র প্রাণ ব্লো-আপ হবার আগেই বাসের উদ্দেশ্যে আসি। পকেট হাতড়ে টিকেট বের করতে গিয়ে দেখি আমার মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স কার্ডটা বেশ শৈল্পিক ভাবে দু'টুকরা হয়ে আছে। নানা ব্যুরোক্র্যাসীর সম্ভাব্য গ্যাড়াকলে পড়ার শংকায় অজান্তেই একটা হ্রস্বশ্বাস বের করে দেয় ফুসফুস। আমি বাসে উঠি।

ভ্যালিড টিকেট নাই। কি সাংঘাতিক মুশকিলের কথা। একজন বাস ড্রাইভার বলেছিলো টিকেট ভ্যালিড সোমবার পর্যন্ত। আর এই ব্যাটা বলে নো ওয়ে। টিকেট কাটো নাইলে বাসে উঠতে দেবো না। কি এক ব্যাড়াছ্যাড়া অবস্থা। হঠাৎ এক দৃষ্টিনন্দিত পাটিকেশী বললো এই যুবককে আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো। ড্রাইভার ব্যাটা কিঞ্চিৎ নাখোশ হয়ে বললো তাহলে তুমি যেখানে নামো সেখানে তাকেও নামতে হবে। ললনাটি আমাকে রিনিঝিনি সুরে জিজ্ঞেস করলো কোথায় নামবো। বলতেই বললো, আরে আমিও তো ওখানেই নামবো। ব্যস, বাস চলতে শুরু করলো। তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমার ভাবনাও গতিপ্রাপ্ত হতে হতে মুক্তবেগকে ছাড়িয়ে গেলো।

বাস থেকে নেমে ললনাটি আমার সঙ্গে আমার ঘরে কফি খাওয়ার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলো। কিন্তু আমি তো কফি খাইনা অনেক দিন হলো। চা-ই খাই বরং। আমাদের পরিচয় হলো জম্পেশ। সম্পর্কের একটা পিরিয়ড পেরিয়ে আমরা আবদ্ধ হলাম পরিণয়ে। পোলাপানে মুখর হয়ে উঠলো বাড়িঘরবারান্দাউঠান। স্লীম ফিগারে বিশাল এক ভুড়ি নিয়ে বুইরা বয়সে বসে আছি পাতায়ার পাড়ে, পাশে বসা এই দন্তহীন বৃদ্ধাটিই বাসে পরিচিত সেই সুদর্শনা ললনা। কিন্তু ও বাংলা শিখলো কবে? আমার সঙ্গে যে বাংলায় কথা বলছে!

ঝাঁকুনি দিয়ে বাস থামলো, ফোঁশফোঁশ শব্দে দরোজা খুললো। আমিও নামলাম। নামলো ললনাটিও। কোন কথা হলো না। শুধু দুটা হাসি বিনিময়, সাথে হাজারটা ধন্যবাদের একটা লাইন। ললনাটি দিল ধাক করা একটি হাসি দিয়ে, আমার উল্টোদিক তাক করে হাঁটা দিলো। আমিও এই গানটি গুনগুন করতে করতে আমার সুইট রুমের দিকে রওনা দিলাম...।