Friday, June 27, 2008

স্বপ্নযাত্রা

: হিথ্রো বাউন্ড!
: ইয়েস এন্ড মে আই রিকোয়েস্ট ফর এ উইন্ডোসীট প্লীজ!
: স্যরি স্যার, অল আর গন। হাউ এবাউট এ নাইস আইল ওয়ান ইনস্টেড!
: ইটস নট মাই চয়েস, বাট ইয়েস প্লীজ।
: এক্সট্রিমলী স্যরি, বাট ইউ আর...
: ইয়েস আই নো। আইল সীট ইজ ফাইন, থ্যাংক্স।

বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে পৌঁছুতে দেরী হয়ে যাওয়ায় চড়ে থাকা মেজাজটা আরেকটু চড়ে যায় প্লাস্টিক হাসি ঝুলানো গোলগাল মুখের তরুণীর কাঠখোট্টা আসন বিন্যাসের ধরণ ধরণ দেখে। জানালার ধারে বসে কয়েক পাত্তর ১৯৯২ সালের দ্রাক্ষারস গলায় চালান করে আয়েশ করে এলিয়ে থাকাটা বোধহয় হচ্ছেনা এবার! অনবরত পাশ দিয়ে কারও না কারও চলাফেরার কারণে সৃষ্ট বিরক্তি এড়াতে আইল সীটটা অপছন্দের খাতায় রয়ে গেছে সবসময়। কেউ হয়তো আকাশে ওঠার আধাঘন্টার মধ্যেই টয়লেটে যাবার বায়না ধরে বসে কিংবা পাশ দিয়ে একটু পরপর ঘটঘট করে একেকজন হোস্টেস বিপুল বিক্রমে হেঁটে যায়, কখনো তাদের সঙ্গে ঘরঘর শব্দ তুলে যায় মালগাড়ি। আর ফেরিওয়ালার মতো বিরক্তিকর একই শব্দের ঘ্যানঘ্যানি তো আছেই!

কাস্টমস, নিরাপত্তা সব পেরিয়ে বিরক্তিকর সোয়া ঘন্টার এক কপাল কুঁচকানো যাত্রা শেষে আবার কানেক্টিংএর ঝামেলা। সাড়ে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করাটাও বিরক্তিকর। বিশাল হিথ্রোর এমাথা-ওমাথা করা যায় বটে! হাতে বহনযোগ্য তেমন কিছু না থাকায় হেঁটে বেড়ানোটাই প্রাধান্য পেলো কোথাও সটান-নির্জীব বসে থাকার চেয়ে। আগে কখনো হিথ্রো দেখা হয়নি। গল্পই শোনা হয়েছে কেবল। বেশ লম্বা একটা জায়গা ধরে হাঁটতে গিয়ে মনে হলো এখানেই হয়তো চৌদ্দ বছর আগে ভাগ্নে জেদ ধরে দৌড় লাগিয়েছিলো এলোপাথারি। বাবা তার পিছুপিছু। দৌড় শেষ করে ক্লান্ত পুঁচকে ভাগ্নে আর পায়ে হেঁটে আসার শক্তি পায় নি। তাকে আসতে হয়েছে বাবার হাতে ঠেলা লাগেজ ট্রলীতে! দৃশ্যটা কল্পনায় আসতেই কপালের কুঁচকানো ভাবটা নিমিষে দূর হয়ে যায়। ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসির একটা রেখাও বোধহয় ফুটে ওঠে। নানা রকম ডিউটিফ্রী দোকানগুলোতে হাঁটতে হাঁটতে সামান্য ক্লান্তি অনুভূত হয়। সামনের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে একটা ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দেওয়া যাক তাহলে এবার।

ইংলিশরা কথা বলে পেটের ভেতর অর্ধেক রেখে, আইরিশরা আরও মারাত্বক! ভালো করে কান পেতে না শুনলে প্রাত্যহিক ইংরেজী ব্যবহার না করা যে কারও পক্ষেই ভাবোদ্ধার করা দুরূহ। ক্যাফেটেরিয়ার আইরিশ মেয়েটা দেখতে অপার্থিব হলেও কথা বলে গড মাস্ট বি ক্রেজী'র কালাহারীর সেই কালো মানুষটার মতো। যে কথা বললে মনে হয় পাখি কিচিরমিচির করছে, তার নিজস্ব ভাষায়! অপার্থিব সুন্দরী, পাখির কলতান- উপমাটা তাহলে নেহায়েতই মন্দ হয়নি। বরং একটা স্নিগ্ধতা ছড়ানো ব্যাপার আছে পুরো উপমায়। কফির স্বাদও খারাপ না। দশে সাড়ে ছয় দেয়া যায়। ফার্স্ট ডিভিশন মার্ক। এখনকার জিপিএ সিস্টেমে কতো হয় কে জানে!

কফিতে তৃতীয় দফা চুমুক দিতে গিয়ে চড়কীর মতো ঘুরতে থাকা চোখে যে জিনিষটা আটকে যায় সেটা সুরুৎ করে নিয়ে যায় বহু বছর আগের এক ঘটনায়। সুমনা, ডেনিম জিন্স আর কালো ফতুয়াতে । তখন সতেরোতে থাকা সুমনার সঙ্গে টক-ঝাল-মিস্টি এক সম্পর্ক। সময়ের স্রোতে সম্পর্কের আচার থেকে টক আর ঝাল জিনিষগুলো ঝরে যায়। তবে মিষ্ট ভাবটা বেশিদিন টিকেনি। সেখানে সামান্য পরিমান তেঁতো যোগ হয়ে যায় কী করে যেনো। হয়তো দূরত্ব, হয়তো অন্য কিছুর কারণে! মিষ্ট-তেঁতো সম্পর্কটা ধ্বসে পড়েছিলো আধাযুগ পরে। পুরো নিশ্চিহ্ন হয়ে হয়তো যায় নি, হয়তো ধ্বংসাবশেষ কিছুটা রয়ে গিয়েছিলো, দাঁড়িয়ে ছিলো ধুঁকে ধুঁকে। সম্পর্কের ধ্বংসাবশেষে যেনো কখনো মোলায়েম হাতের ছোঁয়া গভীর ক্ষত তৈরী করতে না পারে, সেজন্য স্মৃতিকোটরের সেই দরজাগুলো চিরতরে সিলগালা করে দেয়া হয়েছিলো। আর খোলা হয়নি, এতোগুলো বছরেও, দেখা হয়নি কতোটা সৃতির ধূলা পড়লো সেই ভগ্নাংশের ওপর! কতোশত ইচ্ছা ছিলো, স্বপ্ন ছিলো, আকাংখা ছিলো। আটলান্টিকের বিশাল জলরাশি তার সবকিছুই নিয়ে নিয়েছে নিজের বুকে। একটু ক্ষণের দেখা হওয়ার আকুতি ছিলো। নাটকীয়ভাবে দেখা হওয়া বিমান যাত্রায় একসঙ্গে বাকী পথ পাড়ি দেবার কথা ছিলো, ফেরার কথা ছিলো একই সঙ্গে। হাত ধরে খানিকটা সময় চুপচাপ বসে থাকা হয়নি সমস্ত কোলাহল উপেক্ষা করে। কাঁধে মাথা রেখে চুপটি করে ঝিম মেরে থাকার কথা ছিলো কতোবার। কিছুই হয়নি। সময় চলে গেছে সুমনাকে সঙ্গে করে। পথের সেই বাঁকে, ফিরে এসে যেখানে সুমনাকে পাবার কথা ছিলো, মাঝে মাঝেই দূর থেকে চোখ বুলানো হয়। বাঁকটা এখনো রয়ে গেছে সেরকম। সময়ের মরচে ধরেনি আদৌ। কখনো সখনো মৃদু বাতাসে কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে যায় পথের সে বাঁক ধরে। শুধু সময়টাকে বাহন করে সেই বাঁকে আর উড়ে ফেরা হয়না কারোই, কখনোই!

হ্যালুসিনেশন! এই সময়ে, এখানে সুমনার থাকার কথা না। আর যাকে গত বহু বছরে একবারও দেখা হয়নি, তাকে এক পলকে দেখে একবারেই চিনে ফেলাটা কিছুটা অসম্ভবই। অতএব সমীকরণ মেলানো হলো, "সুমনা এই মুহূর্তে এখানে নেই!"

কফি ঠান্ডা হয়ে জমে গেছে সেই কখন। ঠান্ডা কফি খেতেও অবশ্য আলাদা একটা থ্রীল আছে। আইরিশ তরুণীর কলতান আরেকবার শোনার আগে বরং এই থ্রীলটাই গলাধঃকরণ হোক আগে।

অল প্যাসেঞ্জার অফ বিএ-জিরো ওয়ান ফোর ফাইভ, টু ডাক্কা আর রিকোয়েস্টেড টু প্রোসীড... ৪ নাম্বার টার্মিনালের সবগুলো স্পীকার কাঁপানো ঘোষণায় আরেকদফা কপাল কুঁচকানো আগাপাশতলা চেকিং শেষে মাথা ধরানো হাউকাউমুখর কক্ষে প্রায় দশ ঘন্টা ব্যাপী ভ্রমনের মানসিক প্রস্তুতি প্রায় নাগাল ছেড়ে বেরিয়ে যায়, এমন অবস্থা। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় ঠাঁই হলো একদম কোণার দিকের একটা আসনে। ৭৭৭ বোয়িংএ উঠার নাটক মঞ্চায়নের পর্দা উঠতে এখনো বুঝি অনেক দেরী। কানে উপলকে তার "আমি চাই তোমাতে হারাতে" সহ গুঁজে দিয়ে জানালার বাইরে বিশাল এয়ারক্রাফট পরিদর্শনটাই এই মুহূর্তে বুদ্ধিমানের কাজ! আপেক্ষমান সেই কক্ষে মানুষ আসছে-বসছে-দাঁড়াচ্ছে, বসা কেউ দাঁড়াচ্ছে, দাঁড়ানো কেউ হাঁটছে, সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে, হাঁটুক না যার যতো খুশী! কপালটা একটু একটু করে আরও বেশি কুঁচকে যাচ্ছে। কক্ষের আড়াআড়ি একটা আসন থেকে কেউ উঠে সামনে দিয়ে পায়চারীর মতো করে হেঁটে গেলো বারকয়েক। তারপর হঠাৎ থেমে, খানিক ইতস্ততঃ হয়ে জিজ্ঞেস করে, "আপনি, মানে তুমি সম্রাট...!"
সেই পরিচিত কণ্ঠ, কণ্ঠে সেই পরিচিত ঝংকার। দৃষ্টিসীমার ঘুচানো ব্যবধানে সৃষ্ট অস্পষ্টত্ব কাটিয়ে ওঠার পর বুঝা যায়, হ্যালুসিনেশন নয়, এ যে সুমনাই। কতগুলো বছর পর! কপালের ভাজগুলো মুছে যেতে থাকে একএক করে। প্রসন্নতা ফুটে উঠতে থাকে অবয়বে। এতোদিনের বদ্ধকুঠরীর দরজাগুলো একে একে সব সশব্দে খুলে যেতে থাকে যেনো আজ, এই জুনের পড়ন্ত বিকেলে।

: কেমন আছো সু! অনেক শুভেচ্ছা আজকের দিনে তোমাকে।
: মনে রেখেছো তাহলে...।

আরোহন শুরু হয়ে গেছে ততোক্ষণে। এক স্বপ্ন যাত্রার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সম্রাট ভাবে এই স্বপ্নটা সত্যি হলে কী এমন ক্ষতি হয় জগতের!

Monday, June 23, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০৭

মন করুণ পর্ব

ধুসর গোধূলি'র মনটা খারাপ করেছে। তা সে যেন-তেন খারাপ না। একেবারে দশাসই রকমের খারাপ। চিনচিনে খারাপ লাগাটা নেই তবে ভোঁতা ভ্যাপসা ভাব আছে। পুরো শূন্যতা না থাজকেও একটু খালি খালি লাগা আছে। আমার এই একটুর জন্য প্রেমে পড়া হলোনা- মন করুণের আপাতঃ কারণ হিসেবে এটাই দাঁড় করানো গেছে!

ট্রেনে উঠে সুবিধামতো জায়গার আকালে কোথায় বসা যায় এই নিয়ে ভেবে যখন এগুচ্ছিলাম তখনই চারজনা সীটের তিনটাই খালি পেয়ে ধুপুশ করে বসে পড়লাম। যেখানে বসলাম সেটা মোটেও আমার পছন্দের জায়গা না। উল্টোদিকে গাড়ি চললে কেমন উল্টা উল্টা লাগে দুনিয়া। নাকমুখ কুঁচকে সামনের সহযাত্রীর দিক দিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিতেই দেখলাম একজোড়া চোখ বেশ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আমাকে। আমি তাকালাম সে চোখে। ভয়ানক সুন্দর ফটিকা চোখ। মার্বেলের মতো স্বচ্ছ। একটু জুম আউট করলাম আমার দৃষ্টি। মুখায়বটাও দারুণ মিষ্টি। আরেকটু জুম আউট করলাম। নাহ্, এ পর্যায়ের দর্শনাবস্তুর কথা না বলাই ভালো। জুমইন করলাম। দৃষ্টি ডানে বামে ঘুরে ফোকাস মুখায়বে। নাকের ডগাটা একটু টেপ খাওয়া, একটু খাদ কিন্তু কেমন অদ্ভূত মিষ্টতা ছড়ানো সারাটা মুখ জুড়েই। দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম অন্যদিকে।

দৃষ্টি রেঞ্জের ভেতরে থাকায় বুঝতে পারছিলাম তখন সরিয়ে নেয়া চোখ জোড়া আবার আমার মুখের দিকে ফোকাসিত। একটু পর লেন্স ডানে ঘুরিয়ে জানালায় ফোকাস করার সময় চোখে চোখ আটকে গেলো। গোল গোল চোখ, সরে না। একটু পর নামিয়ে নিলো, সরিয়ে নিলাম আমিও। আবার, এবং আবারও, তারপর আবার! এবার আমি সরাবার আগে ভদ্রতাসুলভ মুখ বাঁকালাম।

বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। ওপরের জানালা কাত করা। ঠান্ডা একটা বাতাস ঢুকছে তাই। খুব সম্ভবত শীত লাগছে। জানালাটা লাগাতে চাইছে, পারছে না। কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়াই সাহায্য প্রার্থনা করলো। আমি আস্তে করে উঠে লাগিয়ে দিলাম। সুন্দর-মিষ্টি মুখ ফুটে "আন্তরিক ধন্যবাদ" বের হলো। আমি হাসি দিয়ে ভদ্রতা সূচক উত্তর দিলাম। আবার সেই নীরবতা, দৃষ্টি ক্যামেরার আনুভূমিক সঞ্চারণ এবং সংযোগ! যে কয়বার আটকে গেলো, আমার দেখানো পথ অনুসরণ করে মুখ বাঁকা করে ভদ্রতা করতে চাইলো। ট্রেন যাবে অনেকটা পথ। আমি নেমে যাবো পথে। হিসাব কষছিলাম কোথায় গিয়ে শেষ হবে সুন্দর মুখের যাত্রা।

এক স্টেশন বাকি থাকতে কোলন শহরের নামাঙ্কিত কালো রঙের ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে তাতে তাবাক ভরে পাকিয়ে সিগারেট বানানোর ফাঁকে আমার দিকে তাকিয়ে নিলো। কী জানি ছিলো সেই তাকানোতে! সে নেমে যাবে, কেমন লাগছিলো! কিন্তু সে নামলো না। আমার স্টেশনের অ্যানাউন্স হতেই উঠে চলে গেলো দরজার কাছে। এখন নামতে গেলে যদি ভাবে তাকে ফলো করছি! শালার কপাল...

উঠে দরজার কাছে যেতে আবারও চোখে চোখ পড়লো। আবারও সেই হার্টএ্যাটাক করানো মোনালিসা হাসি। নেমে গেলো আগে, পিছনে আমি ও কয়েকজন। ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে গেলাম। সামনে গিয়ে ঘুরে আবার সে পেছনে এলো। কারও কি নিতে আসার কথা? আসেনি! আমার বাঙ্গুমন দোটানায় পড়ে গেলো। থামবো কি থামবো না! পা চলছে। মাথায় অনেক হিসাব, একের পর এক সশব্দে জট পাকাচ্ছে। চোখ সোজা, পথের দিকে। প্যান্টের পকেটে হাত, স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্লবোরো লাইটের প্যাকেট তুলে নিলো লাইটার সহ। আরেক হাত টুক করে একটা আগরবাতি বের করে সেটা জ্বালায়িত করলো। অবশেষে পা থামলো, থামলাম আমিও। কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দূর টেনে নিয়ে এসেছে হতচ্ছাড়া পদযুগল। এখনতো আর ফেরা যায় না!

Friday, June 06, 2008

যে গল্পটা লেখা হতে পারতো অন্যভাবে

গ্রীষ্ম, ২০০৪
শনিবার বিকেল, এথেন্সের কোনো একটা জায়গা।


বাতাসটা ঝিরঝিরে অবস্থায় আর নেই। হঠাৎ হঠাৎ ধপ করে এসে গায়ে ধাক্কা মেরে পেছন দিকে চলে যাচ্ছে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের এক মানব সন্তানের কালো চশমায় চোখ ঢেকে রৌদ্রস্নানে বসে থাকা এরিয়েলে'র ঠিক যুতসই লাগছে বলে মনে হচ্ছে না। সে তার লাঠিয়াল বাহিনীকে একটু পরপরই খুঁচিয়ে যাবার জন্য পাঠাচ্ছে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মানব সন্তান সেদিকে নির্বিকার। বাঁকা ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে রেখে হাতের ট্রপিক্যাল জ্যুসের গেলাসে একটু পরপর চুমুক দিয়ে যাচ্ছে।

খুব সন্তর্পণে, বালুর সৈকতে পা ডুবিয়ে উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের যুবকটির খুব কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার চোখ বোজা। কিছু একটা ভাবছে নির্ঘাৎ। চোখের বল নড়ছে অনবরত, ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা হাসিটার ও রকম পরিবর্তন হচ্ছে। রোদের আঁচে গাল গুলোয় লালচে আভা ধরে এসেছে। বোতাম খোলা হাফস্লীভ শার্টের পতপত শব্দের সঙ্গে ভেসে আসে কোরাসে'র ভোঁতা সুবাস। যুবকটির পেছন থেকে ধীরে ধীরে তার ডান দিক ধরে দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ রেখে, সামনে দিয়ে ঘুরে এসে তার এলানো শরীরের সঙ্গে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণ তৈরী করে পিছিয়ে আসা যাক, এবারও ধীরে ধীরে।

: কী ভাবছে এই যুবক!
: হোয়াট-এভার!

ফেব্রুয়ারীর এক সকাল, কয়েক বছর আগে-
সিডনী, অস্ট্রেলিয়া।


শনিবার। সাধারণত শুক্রবার রাতে সিনেমা টিনেমা দেখে দেরী করে ঘুমানোর ফলে শনিবার দিনটা শুরু হয় একটু বেলা করেই। জুলিয়া রবার্টস প্রিয় নায়িকা। তার সঙ্গে "তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম" গানের শ্যুটিং সবে শুরু হয়েছে, জুলিয়া ঢাকার জামদানী শাড়ি পরে, পাটক্ষেত মাড়িয়ে দৌড়ে যেই না আমার বুকে এসে ঝপাৎ করে পড়বে অমনি নোকিয়া ৫১১০ একঘেঁয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার মতো ডাকা শুরু করলো। আর কী! জুলিয়াকে ফেলে ৫১১০কেই তুলে নিতে হলো বাধ্য হয়ে। ঘুমে ভেজা গলায় কথাও শুরু করতে হলো-

: হ্যালো...
: নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ। আমি সিজারের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি।

এবারে ঘুম একলাফে বিরাট কাঁচের জানালা দিয়ে পালিয়েছে। ধরমড় করে উঠে বিছানায় বসে-

: জ্বি, বলছি। বলো তোমার জন্য কী করতে পারি।
: উই হ্যাভ এ সিচুয়েশন...!
: দয়াকরে আমার কাছে ব্যাখ্যা করো-

ওপাশ থেকে ঘটঘট হাসি ভেসে আসে। ফাবিয়ান রিবেইরো, আমার ইমিডিয়েট বস।

: ঝটকা খেয়ে গেলা মাইট?
: তোমাকে ুদি ফাবস্। বলো কোন আনন্দে আমার ঘুমের বারোটা বাজালা?
: তুমি কি আজকে কাজ করতে পারবা, এইটা একটা প্লীজ!
: আজকে তো আমার কাজ করার কথা না। তাছাড়া আমি তো ঘুমাচ্ছি এখনো। কিছু মনে করো না। সম্ভব না বাডি, দুঃখিত।
: হ্যাঁ, অপ্রত্যাশিত ভাবেই তোমাকে ডাকতে হচ্ছে। তুমি দরকায় হয় ঘন্টাখানেক পরেই আসো, ব্যাপার না।
: দুইটার আগে পারবো না মাইট।
: ও.কে তাহলে, দুইটায় ই সই। অনেক ধন্যবাদ বাডি। তুমি আমার ুটকি বাঁচিয়েছ। দেখা হচ্ছে তাহলে।
: ইয়াপ...॥

- উইকএণ্ড, দুপুরবেলা কাজ করলে টিপস পাওয়া যায় অনেক। খুব সম্ভবত ফুল অকুপেন্সী। ঘন্টার টাকাও বেশি, টিপসের টাকায় তেলের খরচ উঠে যাবে। ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছেড়ে তৈরী হয়ে সবেধন নীলমনি ফোর্ড ফ্যালকন ৮২তে চড়ে বসলো সিজার।

ফোর্ড ফ্যালকন, সিজারের প্রথম গাড়ি। এক হাজার ডলারে কেনা। চারটা চাকা ছাড়া যার উল্লেখযোগ্য আর কিছুই নেই। ও হ্যাঁ, আছে তো। খুব জোরে বৃষ্টি হলে ছাদ চুঁইয়ে গীয়ার বক্সের উপরে পানি পড়ে, সে পানির ছিঁটায় সীট থাকে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে। ক্যাসেট তো দূরের কথা রেডিওই ঠিকমতো বাজে না, বাজলেও পোঁপোঁ- ফোঁসফোঁস আওয়াজের জন্য কিছুই শোনা যায় না। স্পীডক্লের লাইট নেই- অন্ধকারে তাই দেখার উপায় নেই কতো দ্রুত যাচ্ছে। সেসময় আন্দাজ আপনা আপনা, আন্দাজই ভরসা। হেডলাইট একটা জ্বলে, আরেকটা জ্বলে না। তবে হাইবীম দিলে দুইটাই জ্বলে কিন্তু তখন রাস্তার আর কিছু দেখা যায় না, সামনের গাছপালার উপরের অংশের সামান্য জায়গা ছুঁয়ে আলো চলে যায় আকাশের পানে। (কে জানে, এই গাড়ি যে বানিয়েছে তার হয়তো নভোচারী হওয়ার শখ ছিলো কিংবা নিদেনপক্ষে নাসায় কাজ করার!) প্রথম যেদিন গাড়ি নিয়ে কাজে গিয়েছিলো সিজার, ম্যানেজার (এবং বন্ধু) মাইকেল হিউস ইঞ্জিনের অবস্থা পরখ করার জন্য এক্সেলেটরে বিশাল এক চাপ দিয়ে বের হয়ে তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেই পেছন ফিরেছে, অমনি "জিজাস ক্রাইস্ট" বলে চিৎকার করে উঠেছে। পেছনের রাস্তায় বিশাল একটা জায়গা দখল করে রেখেছে তখন কালো ধোঁয়া!

এই হলো তার ফোর্ড ফ্যালকন। ৮২ মডেল। লাল রঙা বিশাল বপু একটা গাড়ি। একে নিয়েই রওনা দিলো প্যারামাটা রোড ধরে।

হোটেলের স্টাফ চেঞ্জিং রুমে পৌঁছতেই তাকে পেয়ে ফাবস্ দুঃখ প্রকাশ করলো ঘুম থেকে জাগানোর ফলে। সিজারও নো ওয়ারিজ বলে তৈরী হয়ে চেঞ্জিং রুম থেকে বের হয়ে করিডোরে পা ফেললো। লবিতে ঢুকার দরোজার পিতলের হাতলে হাত রেখে যখন সিজার ঢুকছে, সে তখনো জানে না আজকে তার জন্য কী এক অদ্ভুত-আনন্দদায়ক-বেদনাতুর সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে!

টীমমেট এন্থনি পিরী, জ্যাকি চয়, টীমলিডার ডেভিড জেনকিন্স, বেন মেসন- সবাই দৌঁড়ের ওপর। স্যাম জানালো হানড্রেড এণ্ড ফাইভ পার্সেন্ট অকুপেন্সী। সিজারেরও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো কোনো কিছু বুঝার আগেই। গেস্টকে গ্রীট করা, চেক ইন করা এবং সুযোগ বুঝে গেস্টকে ওপরে নিয়ে তার রুমের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেয়া- এই করতে করতে ভয়ানক ব্যস্ততার ঘন্টাখানেক সময় হুঁশ করে চলে গেলো। তখনই ঘটলো ঘটনাটা।

জলবিয়োগ শেষে শিষ বাজিয়ে লবিতে ঢুকার মুহূর্তেই সুন্দরী স্যাম সিজারকে ডেকে বললো, "যদি কিছু মনে না করো, তাহলে এই গেস্টত্রয়কে তাদের রুমে নিয়ে যাবা? এইটা একটা প্লীজ!"

তাদের দিকে একবার তাকিয়ে সিজার হাসি মুখেই রাজী হয়ে যায়। দোতলার দুশ ছত্রিশ নাম্বার রুমে স্ট্রাইপ কী পাঞ্চ করে, ঘরের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেয়। কীভাবে সেফ কাজ করে, কোথায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, কীভাবে সেটা চালাতে হয়, উইনিক ভ্যাকুয়্যাম সিসটেমে টয়লেটে একটু শব্দ হয় ফ্ল্যাশ করলে, হার্টের রোগী কেউ থেকে থাকলে যেনো ভয় না পায়... ইত্যাদি ইত্যাদি।

দুশ ছত্রিশের স্পেশালিটি হলো, এর সাথে লাগোয়া একটা বড়, খোলা বারান্দা। সেখানে সূর্যস্নান করার জন্য রাখা আছে কাঠের কয়েকটা চেয়ার। সেকথা বলতে বলতে সিজার তিনজনের একেকজনের মুখের দিকে তাকায়। দুজনের বয়স পঞ্চাশ পেরোনো বলে ধারণা হয়। এদের একজন খুব কথাপাগল। সেই তখন থেকেই নানা কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে সিজারকে। এলিভেটরে, করিডোরে, এমনকি রুমে ঢুকেও। নেমপ্লেট থেকে নাম জেনে নিয়ে সরাসরি নাম ধরে সম্বোধন করছে। দ্বিতীয়জনও কথা বলার দিক দিয়ে প্রথমজনের প্রায় কাছাকাছি। তৃতীয়জন আপাতত ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখছে, একদমই কোনো শব্দটি ছাড়া।

মুখে একগাল হাসি এনে অ্যান নিজের পরিচয় দিলো। হাত মেলালো। তার ননদ মারিয়া'র জন্মদিন উপলক্ষ্যে সিডনী বেড়াতে এসেছে একদিনের জন্য। মারিয়া'র দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সিজার, জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো হাসিমুখে। অ্যান বললো, তুমি খুব ভালো ছেলে সিজার, এসো আমার মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। সিজারের এতোক্ষণ মনে হচ্ছিলো সঙ্গের প্রীতিজিনটা সদৃশ মেয়েটি হয়তো কথা বলেনা কিংবা বাদামী চামড়ার সিজারকে অবহেলা করতে চাচ্ছে আরদশজন অজিললনার মতো। অ্যানের আমন্ত্রণে একটু ইতস্ততঃ বোধ করে বললো, খুব সম্ভবত তোমার মেয়ে একটু একা থাকতে চাইছে। আর আমাকেও তাড়াতাড়ি নিচে ফিরতে হবে। আমি আশা করছি তোমাদের অবস্থান আনন্দময় হবে আমাদের সঙ্গে! সিজার মুখে এক চিলতে প্লাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে দুশ ছত্রিশ নাম্বার ভরে ওঠে রিনরিন শব্দে।

: আমি আমেন্ডা!

সিজারের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া একটা হলদেটে হাত, মুখে ঝুলানো বুদ্ধিদীপ্ত এক হাসি।

: আমি কথা একটু কম বলি এমনিতেই। কিছু মনে করোনা, প্লীজ! তাছাড়া তুমি কথা বলো খুব সুন্দর করে, তোমার কথাই শুনছিলাম তাই মন দিয়ে।

: যাক, কথা বললে শেষ পর্যন্ত। নাহলে হয়তো এই ধারণা নিয়েই আমি চলে যেতাম যে তুমি হয়তো কথা বলোনা!

হেসে উঠলো সবাই।

: আমার মেয়েটা সুন্দর না অনেক, সিজার?
আমেন্ডা মা-আ-ম বলে মায়ের দিকে কপট রাগের ভঙিতে তাকায়।
: তাতে কোনো, সন্দেহ নেই। আমি মনে করেছিলাম আকাশ থেকে নেমে আসা কোননো নিম্ফ!
দাঁত বের করে সিজার জবাব দেয়।
অ্যান হাসতে হাসতে সিজারের বাহুতে হালকা চাপড় দেয়, "ইউ আর সো নটি!" মারিয়া যোগ করে, "আই শ্যুড রাদার সে, স্মার্ট ওয়ান"।

এবার বিদায় নিয়ে চলে আসে সিজার। সন্ধ্যের দিকে আবার ব্যস্ততা বাড়ে। অন্য অনেক ঘটনার মতো দুশ ছত্রিশ নাম্বারের কথাও ভুলে যায় সিজার।

একই দিন, সন্ধ্যাবেলা
হোটেলের লবি


ব্যস্ততা কমলে ডেভিড কাছে এসে বলে তোমাকে ঐ মেয়েটা খুঁজে গেছে! সিজার অবাক হয়, কোন মেয়েটা?

: ঐযে, যাকে ওপরে নিয়ে গেলে!

সিজার বুঝতে পারে ডেভিড মজা করছে তার সঙ্গে। শুধু ডেভিড না। তার টীমমেটদের প্রায় সবাই খুব মজা করে ওর সঙ্গে। এমন কি ম্যানেজাররাও যোগ দেয় তাতে অনেকসময়। ২১ বছর বয়সেও স্টিল-ভার্জিন, শুকর না খাওয়া, মদ না খাওয়া এসব ব্যাপারগুলো তাদের কাছে দারুণ ইন্টারেস্টিং। প্রথম ডিকে হেসে উড়িয়ে দিলেও আস্তে আস্তে কালচারাল পার্থক্যটা বুঝাতে পেরেছে সে টীমমেটদের। এখন বেশ আগ্রহ নিয়েই তারা জানতে চায় অনেক কিছু। প্রথমদিকের মতো খোঁচামারা মজা আর করেনা কেউ। কিন্তু যে ডেভিড নিজেকে সিজারের বড়ভাই বলে পরিচয় দেয়, সে কেনো আজ এরকম মজা করছে। সিজার বেশ ভালো করেই জানে তাকে কেউ খোঁজেনি!

জ্যাকি চয় ছিলো কাছে। ডেভিড তাকে ডেকে আনলো। জ্যাকিও সায় দিলো কথায়। এবার সিজার বুঝতে পারে, ঘটনাটা পুরোটাই সাজানো। সেও মজা করতে থাকে তাদের সাথে...। এর মধ্যে বার থেকে লবি হয়ে বরিয়ে যাওয়ার সময় চারজনের একটা গ্রুপ থেকে আধামাতাল একটা মেয়ে হঠাৎ করে সিজারের হাতে এক গোছা গ্যাস বেলুন ধরিয়ে দিয়ে বলে এগুলা তোমার জন্য, রেখে দাও! বেলুনগুলো উড়িয়ে না দিয়ে, ঘরে ফেরার সময় সিজার সেগুলো গাড়ির পেছনে বেঁধে নিয়ে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে।

হোটেলটা দাঁড়ানো সিডনী হার্বারের এক পরিত্যাক্ত পীয়ারে। লবির এক পাশে আট ফুট বাই আট ফুট একটা গ্লাস ফ্লোর আছে যার মধ্য দিয়ে তাকালে নিচে নানারকম মাছের ঝাঁক দেখা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সিজার। রিসেপশন ডেস্কে গ্রেস একা, কোনো কাজ নেই। খুব সম্ভবত মেইল চেক করছে। তার পাশেই ডেভিড কথা বলছে ম্যানেজার ট্রেভরের সঙ্গে, ট্রেভর অবশ্য রিভলবীন চেয়ারে একবার ডানে আরেকবার বামে ঘুরছে। লবিবার-এ জ্যাঁ আর জেইসনের মুখ হা হয়ে গেছে ড্রিংক সার্ভ করতে করতে। এমন সময় সিজার তার কাঁধে কারও স্পর্শ অনুভব করলো। পেছন থেকে কেউ হয়তো তাকে চমকে দেবার জন্য এমনটা করে থাকবে। ও ঘুরে মারাত্বক একটা কার্সিং ওয়ার্ড বলতে গিয়েও থেমে গেলো।

সিজার অস্বস্তি মেশানো হাসি দিয়ে বলে,

: আরে আমেন্ডা, তুমি! তোমার মা-ফুফু কোথায়!
: ঐযে বারে, ড্রিংক করছে।
: তুমি করোনা?
: নাহ্, জানো আমরা নৌকা করে সিডনী হার্বারে সারাটা সন্ধ্যে ঘুরেছি।
: বাহ্, তোমরা নিশ্চই অনেক মজা করেছো তাহলে।
: হুমম, তা করেছি। আমি তোমাকে খুঁজেছিলাম বাইরে যাওয়ার আগে।
: তাই নাকি!
: কেনো, বলেনি কেউ!
: হ্যাঁ বলেছে। কিন্তু বিশ্বাস করিনি।
: আমি আসলেই তোমাকে খুঁজেছি সিজার...

- আমেন্ডা এমনিতেই আস্তে কথা বলে। এই কথাটা সে অনেকটা ফিসফিস করে কানের কাছে এসে বললো। মনে হলো, ও কাঁপছে। এই কাঁপুনীর সঙ্গে সিজারের পরিচয় আছে। ও চারদিকে তাকাতে গিয়ে দেখে ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে কয়েকজোড়া চোখ খুব উৎসাহ নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সিজারের আরও অস্বস্তি হতে শুরু করলো। ও নিজেকে একটু সরিয়ে নিয়ে বললো,

: জানো, তোমার জন্য আমার একটা উপহার আছে।
আমেন্ডা এবার খুশীতে ঝলমলিয়ে উঠে হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, "সত্যি!! দাও তাহলে।"

সিজার লক্ষ্য করলো আমেন্ডার হাত কাঁপছে। তার নিজেরও শরীর কাঁপছে কোনো এক অজানা কারণে। মনে হচ্ছে কান দিয়ে সমানে ধোঁয়া বের হচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

: তুমি রুমে যাও, আমি নিয়ে আসছি।
: তুমি আসবে তো!
: হ্যাঁ, আমার আরেকটু পরেই ছুটি হবে, আমি বেরিয়ে যাবার আগে তোমার রুমে নক করে উপহারটা দিয়ে যাবো।
: ঠিক আছে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষ করবো!

এলিভেটর ধরে আমেন্ডা চলে গেলে। যারা এতোক্ষণ তাকিয়ে ছিলো, তাদের দিকে হাত নেড়ে "কী ব্যাপার, কী দেখছো!" ভঙি করে সেখান থেকে সরে যায় সিজার।

রাত এগারোটা
হোটেলের করিডোর


সিজার আস্তে করে নক করে দুশ ছত্রিশের দরোজায়। ভেতর থেকে কারও ছুটে আসার ধুপধাপ আওয়াজ পায়। দরজা খোলা আমেন্ডাই। খুলেই হাত বাড়িয়ে ধরে, আমার উপহার কই?
পেছন থেকে অন্যহাত ঘুরিয়ে এনে বেলুনের তোড়াটা আমেন্ডার সামনে ধরে। আমেন্ডা অনেক খুশী হয়। ভেতর থেকে অ্যান ও মারিয়া হাত নাড়ায়। হাউজকিপিংএর বুড়ো ডানিয়েল অতিরিক্ত বিছানা বানিয়ে দিচ্ছে। এর পরের কয়েক মুহূর্ত কেটে যায় নিঃশব্দে, দরজার চৌকাঠের সীমানায় দাঁড়ানো দুজনের। সিজার বরফ ভাঙে।

: কী করবে এখন, ঘুমাবে?
: নাহ্, খুব সম্ভবত টিভি দেখবো। ঘুম আসবে না। তুমি কী করবে!
: আমি এখন বাড়ি যাবো, তারপর জানি না।

আবারও চুপচাপ। আমেন্ডা পায়ের নখ দিয়ে কার্পেট খুঁটছে, সেটা সিজারের দৃষ্টি এড়ায় না।

: তুমি কি বাইরে যেতে চাও?
: তুমি নিয়ে যাবে আমাকে?
: তুমি যেতে চাইলে, অবশ্যই!

আমেন্ডা মনেহয় এমন একটা কথার জন্যই অপেক্ষা করছিলো এতোক্ষণ।

: তুমি একটু দাঁড়াও, আমি আমার জ্যাকেটটা নিয়ে আসি।
এক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে জ্যাকেট নিয়ে এলো হাঁপাতে হাঁপাতে।
: চলো।
: ঠিকআছে। তুমি মেইন লিফট ধরে লবিতে যাও। আমি স্টাফরুমে চেঞ্জ করে আসছি। প্রধান ফটকের সামনে থেকে তোমাকে ডেকে নেবো!
: আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো...

ফাস্টফোরোয়ার্ডের মতো চেঞ্জ করতে করতে সিজার চিন্তা করার চেষ্টা করলো কী হতে যাচ্ছে। এর আগে তো কখনোই এমন হয় নি। ও কি "ডেট" এ যাচ্ছে! সেটা কী করে সম্ভব! উঁহু, এটা হতে পারে না। সামথিং মাস্ট বি রং।

প্রধান ফটকের সামনে এসে সিকিউরিটি অ্যালান কে সিজার অনুরোধ করলো লবিতে দাঁড়ানো মেয়েটিকে তার কথা বলতে। অ্যালান থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলো, সিজার নিশ্চিত কীনা। কারণ কোনো গেস্টকে উত্যাক্ত করার অপরাধে তার নিজের চাকরিও চলে যেতে পারে। সিজার অ্যালানকে আশ্বস্ত করলো, জাস্ট গো এন্ড টেল হার দ্যট আই এম হিয়ার!

অ্যালান কে হা করিয়ে রেখে আমেন্ডা হাসি মুখে বেরিয়ে এলো। তারা হাঁটতে শুরু করলো হার্বার সাইড ধরে। ব্রীজ পেরিয়ে, হায়াত হোটেলের সামনের কাঠের জায়গাটুকু পেরিয়ে সার্কুলার কী, ফেরী ওয়ার্ফ পেরিয়ে যায় তারা একে একে। সিজার অবাক হয়, অস্ট্রেলিয়ান হয়েও মদ আর সিগারেটের প্রতি মারাত্বক অনীহা আমেন্ডার। আরও আশ্চর্য হয়ে গেলো যখন বললো, "সিজার আমি তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি।"

সিজার তখন বিষম খেয়ে বোকার মতো প্রশ্ন করে বসে, "কী!! আমি ই কেনো!"
আমেন্ডা হাসে, "সেটা তো বলতে পারবো না। শুধু জানি আমার অনুভূতি বলছে যে আমি তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি!"
সিজার এবার বলে,"হ্যাঁ আমিও তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি আমেন্ডা"
কথাটা বলে সিজার বুঝতে পারে না সে সত্যি বললো না মিথ্যে। তার কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না এখন। মাথা পুরো ফাঁকা মনে হচ্ছে। কিছুই নেই, সব ফকফকা।

আমেন্ডা সিজারের একটা হাত তুলে নিলো তার হাতে। খুব সন্তর্পণে সেই হাতটা নিজের বুকে চেপে ধরলো। সিজার আমেন্ডার বুকের উষ্ণতা টের পেলো, আঙুলের মাথায় উঁচু মাংসপিন্ডের অস্তিত্ব টের পেলো সে। তার সারা শরীর ঝাঁকা দিয়ে গেলো। সিজারের আর কোনো বোধশক্তিই অবশিষ্ট নেই। যেকোনো মুহূর্তে ঠাশ করে পরে যাবে বুঝি! এ কোন যন্ত্রণা হলো। কী বলছে তা সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে না।


রাত বারোটা নাগাদ,
অপেরা হাউজ, সিডনী হার্বার


অপেরা হাউজের একদম উপরের ব্যালকনিতে রেলিং ঘেঁষে দুজন দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। হঠাৎ আমেন্ডা সিজারের ধরে থাকা হাতটা আস্তে করে ছেড়ে দেয়। সিজার বুঝতে পারেনা। সিজার তার হাত ধরতে গেলে আমেন্ডা বলে, "আমি ঠিক আছি। এভাবেই ভালো লাগছে।"
সিজার বুঝতে পারে কোনো গোলমাল হয়েছে। আস্তে আস্তে তার স্বাভাবিক সম্বিত ফিরে আসতে শুরু করে। কিছুক্ষণ আগের কথোপকথন মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। নাহ্, খুব খারাপ কিছু বলেছে বলে তো মনে পড়ছে না তার! এভাবেই কথা চলতে থাকে কিছুক্ষণ। আমেন্ডাই হঠাৎ বলে ওঠে, "হোটেলে ফেরা প্রয়োজন।"
সিজার অবাক হয়, একটু আগেও বলছিলো সারারাত বসে কাটিয়ে দেবে হার্বারে, সিজারের সঙ্গে। অথচ এখন ফিরে যেতে চাইছে। সিজার আবারও জিজ্ঞেস করে, সব ঠিক আছে কীনা!
আমেন্ডা হেসে মাথা নাড়ায়! সিজারের সন্দেহ দূর হয় না।

রাত, বারোটা চল্লিশ
ওয়লশ বে, পিয়ার ওয়ান, সিডনী হার্বার


হোটেলের সামনে এসে এবার সিজার সামান্য জোর করে।
: কী হয়েছে বলো আমাকে। এক ঘন্টার ব্যবধানে তোমাকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে আমার।
: আই এম ফাইন সিজার। ইটস ও-কে!
: তুমি কি আমার কোনো কথায় কষ্ট পেয়েছো?
আমেন্ডা মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে। সিজার জানতে চায় আবারো। আমেন্ডা চোখ তুলে তাকায়, তার চোখ লাল, টলমল করছে পানিতে। চকিতে সিজারের একটা হাত তুলে নিয়ে, তারায় চুমু খেয়ে দৌড়ে হোটেলে ঢুকে যায়। হতভম্ব সিজার তাকিয়ে থাকে সেদিকে, অনেক্ষণ।


পরিশেষ

- এর পরের ঘটনা আমরা আর জানি না। সিজারের সঙ্গে আমেন্ডার আর দেখা হয়েছিলো কীনা তাও জানি না আমরা। সিজার পরদিন খুব ভোরে সার্কুলার কী-তে ম্যাকডোনাল্ডসের সামনের ফুলের দোকানটা থেকে এক গোছা ভিন্নবর্ণের ফুলের তোড়া নিয়ে দুশ ছত্রিশ নাম্বার রুমের দরজায় নক করেছিলো কিনা তা জানা যায় নি। কোয়ান্টাসের বিভিন্ন মিটিংএ বসে আমেন্ডা সিজারকে একটার পর একটা এসএমএস করেছিলো কিনা তা আমরা জানি না। এই ঘটনার কিছুদিন পর সিজার নতুন গাড়ি কেনে। হোন্ডা সিভিক ৯২। ভালোবাসা দিবসে অনেক কষ্টে আমেন্ডার ঠিকানা যোগাড় করে সেই গাড়ির পেছনের সীট বোঝাই করে ফুলের তোড়া নিয়ে সিজার আমেন্ডার ঠিকানায় হাজির হয়েছিলো কিনা তা জানা যায় নি। সিজার অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আসার খবরে আমেন্ডা ফোন করেছিলো কিনা, কিংবা করলেও কী বলেছিলো সেটাও থেকে যায় আমাদের অজানা। আমরা জানি না সেদিন অপেরা হাউসের সামনে কোন কথাকে মনে ধরে আমেন্ডা গুটিয়ে নেয় নিজেকে। আমরা জানি না সিজার ও আমেন্ডা একে অপরকে সত্যিই পছন্দ করে ফেলেছিলো কীনা!

এথেন্সে রৌদ্রস্নানরত সেই যুবক উঠে যায়। পকেট থেকে নীল রঙের বিশ ইউরোর একটা নোট বের করে হাতের গ্লাসটা দিয়ে চাপা দেয় চেয়ারে। কালো চশমাটা নেড়ে ঠিক করে এগিয়ে যায় অদূরে থামিয়ে রাখা ছাদখোলা লাল মাজদার দিকে। গাড়ির ইঞ্জিন ঘরঘর শব্দে চালো হয়ে পেছন দিকে কিছু ধূসর ধোঁয়া ছড়িয়ে দেয়। রাস্তার ডান দিক ধরে গাড়িটি এগিয়ে যেতে থাকে সিনডাগমার দিকে। পেছন থেকে গাড়িটির গতি অনুসরণ করতে করতে আমরা ওপরে উঠে যাই সময়ের সিঁড়ি বেয়ে। আমাদের কানে ভেসে আসে এরকম একটা সঙ্গীত। আমরা জানি না, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের যুবকটির আসল গন্তব্য কোথায়...!