Sunday, April 01, 2007

স্কুলের টিফিনের টাকার জন্য...

স্কুলের বারান্দায় দাঁড়ানো শীর্ণ বসনের কোন এক কিশোর গভীর শূন্যদৃষ্টি মেলে দেয় আকাশের দিকে। বিড়বিড় করে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে কি যেন বলে। শক্ত চোয়াল, ক্ষিপ্র চাহনীতেই বুঝা যায় ঝগড়ায় মত্ত সে জগৎ-পিতার সাথে। হঠাৎ করেই ক্লাস রুমে ঢুকে ছোঁ মেরে বেঞ্চের ওপর থেকে বইগুলো তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

গ্রামের স্কুল, অত পাহাড়া কোথায়! টিফিন পীড়িয়ডে সবাই ব্যস্ত টিফিনে। ছেলেদের একটা জটলা ঘিরে আছে স্কুলের পাশের পুরির দোকানটিতে। দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটি কতোক্ষণ পুরি ভাজা দেখে।

বিকেল পর্যন্ত থাকা লাগে স্কুলে, কিছু একটা পেটে না পড়লে টিফিনের পরের ক্লাস গুলোর কিছুই যেন ঢুকেনা মাথায়। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ছেলেটি দিনের পর দিন স্কুলের ক্লাস গুলো করে যায়। পুরির দোকানী একের পর এক খোলা পুরি ভেজে সামনের নিউজপ্রিন্ট বিছানো বড় থালাটিতে রাখে। ছেলেটির সহপাঠীদেরই অনেকেই ভেতরে বসে তেঁতুলের চাঁটনী সহযোগে গরম গরম পুরি খেয়ে যাচ্ছে। সে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে....।

দরিদ্্র বাবার কোন সামর্থ্য নেই ছেলের স্কুলের খরচ যুগিয়ে টিফিনের জন্য পয়সা দেয় আলাদা করে। ঠিক করে, সহপাঠীদের টিফিন খাওয়ার দৃশ্যে তাকিয়ে না থেকে নিজেই উপার্জন করবে নিজের টিফিনের খরচ। যোগার করে আরও দুইজন তার মতো বন্ধু। তিনজনে মিলে ঠিক করে কাছে কোথাও মজুরি খাটবে। যে টাকা পাবে তা তিনজন ভাগ করে নিবে। কিন্ত খবরদার! বাড়িতে জানানো যাবে না- তাহলে বাবা পিঠের চামরা আস্ত রাখবে না।

পরদিন সকালে তিনজন স্কুলের নাম করে বেরিয়ে যায় মজুরির খোঁজে। মিলেও যায়। গ্রামের এক গৃহস্থের ধানক্ষেতে নিড়ানি দেবার কাজ। চুক্তি 150 টাকা। সারাদিন তিনজনে হাড়ভাঙা খাঁটুনি দিয়ে উপড়ে ফেলে গৃহস্থের বেঁধে দেয়া বিরাট সীমানার ক্ষেতের আগাছা। সন্ধ্যায় গৃহস্থ 100 টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে বাকিটা কাল দিবে, হাটে।

তিন বন্ধু চলে আসে। পরদিন স্কুলে যায়। এবার তারাও টিফিন টাইমে পাশের দোকানের পুরি খেতে পারবে, গরমে চান্দি ফাটার সময় খেতে পারবে আইসক্রিমও। এক বন্ধু হঠাৎ মনে করিয়ে দেয়, গতকালের পাওনা 50 টাকার কথা। আগে টাকাটা নিয়ে তারপরেই নাহয় টিফিন করা যাবে একসাথে মজা করে। গৃহস্থের কাছে যায় তিনজনই। টাকা চায় শূন্যদৃষ্টি মেলে ধরা সেই ছেলেটি। কিন্ত একি...!

গৃহস্থ টাকা দেয়ার বদলে ছেলেটিকে জোরে জোরে কিল-চড়-ঘুষি মারতে থাকে অনবরত। দরিদ্্র বাবা মায়ের সেভেন পড়ুয়া সন্তান, সে কেন বয়স্ক , শক্ত পেশীর গৃহস্থের হাতের কঠোর মার সহ্য করতে পারবে! ঘটনাস্থলেই দমবন্ধ হয়ে মারা যায় ছেলেটি।

পুলিশ আসে, গৃহস্থ স্বীকার করে পাওনা 50 টাকার কথা, কিন্ত আঘাতের কথা নয়। বাকিদুজন কিশোর বন্ধু কাঁদতে কাঁদতে সাক্ষ্য দেয় ঘটনার। পুলিশ নিয়ে যায় ছেলেটির লাশ আর গৃহস্থকে। হয়তো লোকটির বিচার হবে, ফাঁসির রায় হবে বিচারে, কিন্ত -

দরিদ্্র মা-বাবা কি ফিরে পাবে তাদের নয়নের ধন ছেলেকে? যে ছেলেটিকে মাত্র 50 টা টাকার জন্য বেঘোরে প্রাণ দিতে হলো!
=========================

তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলো
উৎসর্গ : রংপুরের জিকরুল হক, যে কেবল 14 বছর বয়সেই চেষ্টা করেছিলো নিজের পায়ে দাঁড়াতে, বাবা মায়ের বোঝা খানিকটা হালকা করতে।

মনটা খারাপ খবরটা পড়ার পর থেকেই

No comments: