Wednesday, April 25, 2007

বৈশাখ : বাঙালী জাতির সংগ্রামের আরেক আখ্যান

******************************

এবার হাজারদুয়ারীর নতুন সংখ্যা আপলোড করার আগ মূহুর্তে দারুণ কিছু সময় কেটেছে ভোর বেলা, পাখীদের কলতানে। মনে হইছে আমি যেন সেই গ্রামের রাস্তাটা ধইরা একটা ভোঁ দৌড় দিতাছি...

*******************************


চৈত্রসংক্রান্তি, চৈত্র মাসের শেষদিনটির গোধূলী লগ্নে ধূলো উড়িয়ে ঘরে ফেরা রাখাল কি জানে একটু পরেই লাল সূর্যটা ডুবে গিয়ে যে নতুন দিনের আগমনী বার্তা জানাবে সেই নতুন দিনের আগমন ইতিহাস! গাঁয়ের মহাজন কি জানে তাঁর খাজাঞ্চি বগলের নিচে যে লাল মলাটের স্বাস্থ্যবান খাতাটি নিয়ে ঘুরে তার হিসাব বন্ধের পিছনে 'হালখাতা' নামক শব্দটির ইতিহাস! গঞ্জের পাইকারী ব্যবসায়ী কি জানে, তাঁর সকল ক্রেতার কাছ থেকে পুরনো বছরের হিসাব বুঝে নিয়ে যে মুফতে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিলো তার পেছনের ঘটনা! কিংবা ওইযে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, অশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে অভ্যস্ত যে ছাত্রটি গায়ে দামী পাঞ্জাবী চড়িয়ে সাতসকালে রমনার বটমূলে গিয়ে হেরে গলায় "এসো হে বৈশাখ, এসো এসো" গানে তাল মেলাচ্ছে সে কি জানে এই গানটির পেছনের ইতিহাস!

আমি নিশ্চিত না হয়েও বলতে পারি, অনেকেই জানে না বৈশাখের ইতিহাস, বৈশাখের ঐতিহ্য, বৈশাখের আবেদন একজন বাঙালীর জীবনে কতটুকু।

বৈশাখ বাঙালীর জীবনে এমনি এমনি আসেনি। এদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি বারবার চেষ্টা করেছে বৈশাখের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে, প্রচার করেছে "হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি" বলে। কিন্ত ইতিহাস বলে, যার হাত দিয়ে বৈশাখ কিংবা বাংলা নববর্ষের গোড়াপত্তন হয়েছে তিনি কেবল মুসলমানই ছিলেন না বরং সারা মুসলিম বিশ্বে একজন নামকরা, উদারপন্থি শাসক হিসেবে আজও পরিচিত। সেই জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের শাসনভার গ্রহনের আগে মুঘল আমলের পুরোটা সময় ধরেই কৃষিখাজনা আদায় হতো হিজরী সনের হিসাবে।

হিজরী সন আসলে চাঁদের হিসাব অনুযায়ী নির্ধারিত হয় কিন্ত উপমহাদেশের সারা বছরের কৃষিকাজ চাঁদের সাথে অতোটা সম্পর্কায়িত নয়, যে কারণে কৃষকেরা তখন খাজনা প্রদানে প্রতিকূলতার স্বীকার হতো। যথাসময়ে যথাযোগ্য খাজনা আদায়ের অভিপ্রায়ে তখন সম্রাট আকবর তাঁর সভার বিশিষ্ট গুণীজন ফাতেউল্লাহ্ সিরাজীকে দিয়ে হিজরী চন্দ্রাব্দ এবং বাংলা পঞ্জিকার সমণ্বয়ে "বাংলা বছর"-এর প্রচলন করেন, যা "ফসলী সন" নামে ১৫৮৪ এর মার্চ মাসে প্রবর্তিত হয়। আসলে ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিনটি থেকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বছরের সূত্রপাত হয়।

সম্রাট আকবরের আমল থেকেই বাংলা নতুন বছরাগমনের অর্থাৎ বৈশাখের প্রথম দিনটির উৎসবমূখর উদযাপন হয়ে আসছে। বছরের শেষদিন, চৈত্রসংক্রান্তির সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুব দেবার আগেই পুরাতন অর্থবছরের সকল হিসাব চুকিয়ে ফেলার নিয়ম। বছরের প্রথম দিন মহাজন, ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতা বন্ধুদের নিমন্ত্রন করে মিস্টিমুখ করানোর মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবসায়ীক লেনদেনের পুনঃসূচনা করতেন "হালখাতা" বা হিসাবের নতুন খাতা খুলে। লুপ্তপ্রায় এই ধারাটা সোনা-ব্যবসায়ীরা আজও ধরে রেখেছে।

সম্রাট আকবরের আমলে সর্বভারতে খাজণা আদায়ের নতুন বছরের সূচনা হলেও, পুরনো দিনের সকল হিসাব পেছনে ফেলে আনন্দের নতুন বছরে পদার্পন বাঙালীদের মাঝে ঐতিহ্য হিসেবে টিকে গেছে। সবচাইতে বর্ণাঢ্য বৈশাখ উদযাপন হয় ঢকা শহরকে ঘিরে। বছরের প্রথম সূর্যের আলোকে বরণ করে নিতে দলে দলে লোক সমবেত হয় রমনার বটবৃক্ষের তলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের তত্ত্বাবধানে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, যা সারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর প্রদক্ষিণ করে। সাদা পাজামার সাথে পাঞ্জবী পরিহিত ছেলেদের পাশে খোঁপায় বেলী ফুলের মালায় সজ্জ্বিত হয়ে, লাল পেড়ে সাদা শাড়ীর তরুণীরা মেতে ওঠে "ইলিশ-পান্তা" উৎসবে।

গ্রামাঞ্চল ও কোনদিক দিয়ে পিছিয়ে নেই "পহেলা বৈশাখ" উদযাপনে। জায়গায় জায়গায় বসে মেলা হরেক রকম জিনিষের পসরা সাজিয়ে। বাড়ি বাড়ি বিলানো হয় ঘরে তৈরী মিস্টি, নতুন চালের পায়েস ইত্যাদি।

আর সবকিছু ছাপিয়ে এ প্রজন্মের একজন বাঙালীকে বৈশাখ যা শেখায় তা হলো সংগ্রাম করার সংকল্প। বাংলা সংস্কৃতির ওপর কালো থাবা বিস্তারে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। পাকিস্তান সরকারের এই অন্যায় আচরণের জবাব দিতেই "ছায়ানট" ১৯৬৫ সালে রমনার বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "এসো হে বৈশাখ এসো এসো" গানটি দিয়ে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করে। বস্তুত এই দিনটি থেকেই "পহেলা বৈশাখ" বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম এক পরিচায়ক রূপ ধারণ করে। ১৯৭২ সালে 'পহেলা বৈশাখ' বাংলাদেশের জাতীয় পার্বন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবার আগ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার ২১এ ফেব্রুয়ারীর মতোই থামিয়ে দিতে চেয়েছে বৈশাখের উদযাপন। সেই সূত্র ধরেই ২০০১ সালের বোমা-গ্রেনেড হামলা।

কিন্ত অজেয় বাঙালীর সামনে মাথা তুলে কোনদিনই দাঁড়াতে পারেনি কোন সাম্প্রদায়িক শক্তি। পহেলা বৈশাখের আবেদনও শেষ হয়ে যায়নি শত বাঁধার মুখেও। ঢাকা পেরিয়ে বৈশাখ আজ পালিত হয় জার্মানীর প্রাক্তন রাজধানী বনেও, পালিত হয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শহরে যেখানে ন্যূনতম সংখ্যক বাঙালীও বিদ্যমান।

এইতো আমাদের বাঙালী ঐতিহ্য, এইতো আমাদের বৈশাখের ঐতিহ্য, শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে, সহস্র প্রতিকূলতা পেরিয়ে, রাস্ট্রীয় অস্থিতিশীলতার মাঝেও আমাদেরকে মাতিয়ে তোলে বর্ষবরণ উদযাপনে।

দেরীতে হলেও আমার ব্লগের পাঠকদের জন্য রইলো বাংলা নতুন বছরের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

************************

লেখাটি একই সাথে হাজারদুয়ারীতে প্রকাশিত।

No comments: