Tuesday, February 05, 2008

সময়ের উৎসবে কিছু অন্যসময়ের গল্প

ঠিক করেছি পুরানো কনটাক্টগুলো ঝালিয়ে নেবো এবার। বন্ধু বান্ধবরা সবগুলো দূরে দূরে সরে যাচ্ছে একেকজন ব্যস্ততার অজুহাতে। হঠাৎ ভালো লেগে যাওয়া একজনকে বেশ অনেকদিন বাদে শোনা হলো, অপ্রত্যাশিত ভাবে। নিজের দুনিয়া সাজাতে গিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে স্কয়ারের বিজ্ঞাপনের আদলে স্কয়ারের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে রেখেছে। এখন তাকে হঁটিয়ে নিজেকে সেই জায়গায় বসানোর ধান্ধায় আছি। দেখি গ্রীন সিগনাল পাই কিনা, না পেলেও অসুবিধা নেই। রেড লাইটেও গাড়ি চালানোর অভ্যাস আমার আছে।

বছরখানেক আগেও ফুলি বেগমের সঙ্গে বেশ ভালো যোগাযোগ ছিলো। সপ্তাহান্তে সকালে ফোন করে ঘুম থেকে তুলে আমাকে নাশতা করাতে নিয়ে যেতো ক্যাফে গোয়েটলিশ কিংবা মুনস্টারপ্লাৎসে বেকার সাহেবের দোকানে। আমি ঘুম ঘুম চোখে ঢলতে ঢলতে বাটার ক্রঁসো তে দাঁত বসিয়ে আয়েসী ভঙিতে ধোয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিতাম চুকচুক করে। তার উদ্দেশ্য ছিলো আরও মারাত্নক। আমাকে বিখ্যাত বইয়ের দোকান 'বুফিয়ের'এ নিয়ে গিয়ে সুনসান নীরবতায় বই পড়া এবং পড়ানো। ও আয়েশ করে একটা সোফাতে বসতেই আমি উঠে চলে যেতাম এমন একটা সেকশনে যেখানে সব কামাসূত্রার নানারকম সব সচিত্র বই থরে থরে সাজানো আছে। বিরাট বোদ্ধার মতো এক হাতে থুতনী চেপে আরেক হাতের তর্জনী দিয়ে মলাটের ওপর নজর বুলাতাম, 'কোন বইটা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে'!

আমাকে এদিক-ওদিক খুঁজে না পেয়ে জায়গামতো এসে ফুলি বেশ উঁচু স্বরেই জিজ্ঞেস করতো, 'তুমি এখানে করো কি? দুনিয়ার এতো বিখ্যাত বিখ্যাত সাহিত্য, এতো নামীদামি বই কি তোমার চোখে পড়ে না! ওগুলা রেখে এইসব খাইস্টা জিনিষে কি দেখো।' এখন আমি এই বালিকা কে কি করে বুঝাই যে দুনিয়ার যতো রহস্য, যতো হাংকিপাংকি সবই আছে এই সেকশনে! সে আমার বুঝদার লেকচারের তোয়াক্কা না করে রীতিমতো হিঁচড়ে নিয়ে লাল রঙের একটা সোফায় বসায়, হাতে ধরিয়ে দেয় একটা জিওগ্রাফীর বই। আমি দেড় মিনিটে পুরা একশো ষাট পাতা শেষ করে ফেলে বলি বই শ্যাষ। আমি অন্য সেকশনটা একটু ঘুরে আসি। মিনিট দশেক পরে আবার এই বেরসিক ফুলি আমাকে পাকড়াও করে রসিক সেকশনে এসে। কী ঝামেলা!

সেদিন কথা হচ্ছিলো। বলে তুমি কি ইদানিং খুব বেশি বিড়ি ফুঁকছো না? আমি বলি, কই নাতো। তেমন আর বেশি কই। আগেতো এর সঙ্গে গঞ্জিকাটাও যুক্ত ছিলো, এখন না আমার সোর্সগুলো টার্ণআপ করছে না। শালা পাঠার দল। কই যে ডুব দিলো! শুনে ফুলি বেগম চোখ কপালে তোলে, 'গেছ তুমি'!

আজকে কাজের ওখানে হঠাৎ করেই ভড়াক করে বমি করলাম। তারপর আবার করলাম। এক পশলা কান্না করে, মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতেই আবার বিশাল ধাক্কা। এবং আবার কমোড ভাসানো, চোখের পানি নাকের এক করে সশব্দে আবার কান্না। আমি বমি করতে পারি না, ছোটবেলায় যেমন করে কাঁদতাম, এখনো সেভাবেই কাঁদি। ফুলি বেগমের সাথে দেখা হলে বলে তোমার কপাল 'পেল' হয়ে আছে। বমির কথা বলতেই বলে, সিদ্ধি টানো কেনো? বললাম লেও হালুয়া। ভাত ছাড়া তো আর কিছুই খাই নি, ঈমানে বলি। মনে হলো বিশ্বাস করে নি। না করুক, কার কি!

সন্ধ্যায় এক পুরানো পরিচিতের সঙ্গে দেখা হলো। এক সঙ্গে বিড়ি ফুঁকলাম স্টেশনে হলুদ মার্জিন দিয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া জায়গাটায়। শেষ হতেই আবার ভড়াক। পকেট থেকে পলিথিনটা বের করে সময়মতো জায়গামতো সেট করতে না পারলে প্রেস্টিজ ধরে টান পড়তো। কার্ণিভালের সময়ে যেখানে সেখানে বমিত্যাগ একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার। বেহুঁশ হয়ে লোকজন পাগলা পানি গিলে যে! আমার কষ্টটা লাগে কিছু না গিলেও রাস্তা ঘাটে পলিথিন পকেটে নিয়ে ঘুরতে।

শনিবার রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘরে ফেরার পথে হঠাৎই দেখা হয়ে গেলো ডয়চেভেলের বন্ধুদের সঙ্গে, প্রায় মাস দুয়েক পর। পাকড়াও করে নিয়ে গেলো নতুন পরিচিতা হুমা তার বাসায়। চারজন মিলে গোশত-ডাল-রুটি সাবাড় করে বাদ শায়েরী শ্রবন একসঙ্গে ডিসকো যাবার পালা। অনেক আগে যখন বিশাল এক কাফেলা যেতাম কোলনের শিভাবারে, সেটা ছিলো অন্য সময়। তারপর আর আউটিংয়ে যাওয়া হয়নি। বন-এ তো কোন কালেই নয়। এবার যেতে হলো। দরোজায় বিশাল বপু গার্ড জানিয়ে দিলো কার্ণিভাল পার্টি চলছে ভেতরে। তোমাদের মতো স্যুটেড-বুটেড হয়ে আজকে ঢুকা যাবে না। কস্টিউম পরে আসো। খাইয়া কাম নাই, লও যাইগা। বলে হাঁটা দিলাম। ইউনিভার্সিটির এখানে ব্লোআপ, জায়গাটা খারাপ না। ঢুকে গেলাম চারজনে।

জিঞ্জারএল হাতে নিয়ে বসতেই দেখি মাথায় বাবরি চুল লাগানো বিশাল এক সুদর্শনা আমার পাশের জুটির ফটুক তুলছে। ওখানে একটু ঝুঁকি নিয়ে উঁকি মারতেই ফটোগ্রাফার ললনাটি সুন্দর একপাটি দাঁত বের করে হেসে দিয়ে আমার ফটুক তোলার অনুমতি চাইলো। আমি রাজী হয়ে মডেল হিসেবে চাইলাম তার বান্ধবীকে। বান্ধবী রাজি হয়ে বসে পড়লো ধড়াম করে আমার পায়ের ওপর। আমি কোৎ করে উঠলাম ভরের ঠেলাম। ফটুকে দেখলাম আমি কুঁকড়ে আছি আর ললনা দন্তবিকশিত-আকর্ণ হাসিতে দ্রবীভূত। ওই অবস্থাতেই পলিটিক্স নিয়ে প্যাঁচাল। আমি নানা কথা ঘুরিয়ে পদার্থবিদ্যার ভরের নিত্যতা সূত্র নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমাকে থামিয়ে দেয় জনগণ। পলিটিক্স নিয়ে কথা বলতে আমারও কোন আপত্তি নেই, আগেতো ভরবেগের সূত্রটা জানা উচিৎ!

ললনা সবিনয়ে জানতে চাইলো আমার ফোন নাম্বার রাখতে পারে কিনা। ভারে আমার 'রা সরে না, মাথা ঝাঁকাই। সম্মতি পেয়ে ললনা উঠে যায় তার মুঠোফোন আনতে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আমার করুণতায় বাকী তিনজন খলখল করে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে ব্লোআপে ঠেলাঠেলিতে নিজের পিতৃপ্রদত্ত একটা মাত্র প্রাণ ব্লো-আপ হবার আগেই বাসের উদ্দেশ্যে আসি। পকেট হাতড়ে টিকেট বের করতে গিয়ে দেখি আমার মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স কার্ডটা বেশ শৈল্পিক ভাবে দু'টুকরা হয়ে আছে। নানা ব্যুরোক্র্যাসীর সম্ভাব্য গ্যাড়াকলে পড়ার শংকায় অজান্তেই একটা হ্রস্বশ্বাস বের করে দেয় ফুসফুস। আমি বাসে উঠি।

ভ্যালিড টিকেট নাই। কি সাংঘাতিক মুশকিলের কথা। একজন বাস ড্রাইভার বলেছিলো টিকেট ভ্যালিড সোমবার পর্যন্ত। আর এই ব্যাটা বলে নো ওয়ে। টিকেট কাটো নাইলে বাসে উঠতে দেবো না। কি এক ব্যাড়াছ্যাড়া অবস্থা। হঠাৎ এক দৃষ্টিনন্দিত পাটিকেশী বললো এই যুবককে আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো। ড্রাইভার ব্যাটা কিঞ্চিৎ নাখোশ হয়ে বললো তাহলে তুমি যেখানে নামো সেখানে তাকেও নামতে হবে। ললনাটি আমাকে রিনিঝিনি সুরে জিজ্ঞেস করলো কোথায় নামবো। বলতেই বললো, আরে আমিও তো ওখানেই নামবো। ব্যস, বাস চলতে শুরু করলো। তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমার ভাবনাও গতিপ্রাপ্ত হতে হতে মুক্তবেগকে ছাড়িয়ে গেলো।

বাস থেকে নেমে ললনাটি আমার সঙ্গে আমার ঘরে কফি খাওয়ার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলো। কিন্তু আমি তো কফি খাইনা অনেক দিন হলো। চা-ই খাই বরং। আমাদের পরিচয় হলো জম্পেশ। সম্পর্কের একটা পিরিয়ড পেরিয়ে আমরা আবদ্ধ হলাম পরিণয়ে। পোলাপানে মুখর হয়ে উঠলো বাড়িঘরবারান্দাউঠান। স্লীম ফিগারে বিশাল এক ভুড়ি নিয়ে বুইরা বয়সে বসে আছি পাতায়ার পাড়ে, পাশে বসা এই দন্তহীন বৃদ্ধাটিই বাসে পরিচিত সেই সুদর্শনা ললনা। কিন্তু ও বাংলা শিখলো কবে? আমার সঙ্গে যে বাংলায় কথা বলছে!

ঝাঁকুনি দিয়ে বাস থামলো, ফোঁশফোঁশ শব্দে দরোজা খুললো। আমিও নামলাম। নামলো ললনাটিও। কোন কথা হলো না। শুধু দুটা হাসি বিনিময়, সাথে হাজারটা ধন্যবাদের একটা লাইন। ললনাটি দিল ধাক করা একটি হাসি দিয়ে, আমার উল্টোদিক তাক করে হাঁটা দিলো। আমিও এই গানটি গুনগুন করতে করতে আমার সুইট রুমের দিকে রওনা দিলাম...।

No comments: