Thursday, April 03, 2008

আজ মন খারাপ করা দিন

আসাম ব্লেণ্ডের টি-ব্যাগ, ওয়াটার কুকারে টগবগ করে ফুটতে থাকা পানি, পাশে কি জানি একটা বিদঘুটে নামের কনডেন্সড মিল্কের টেট্রাপ্যাক। খুঁজে পেতে চা খাওয়ার মগটা বের করা গেলেও চিনির কৌটাটা কেনো যেনো আমার সঙ্গে 'লুকোচুরি' খেলছে। সব হাতের কাছে থাকার পরেও তাই চিনি ছাড়াই চা মুখে তুলতে হচ্ছে।

আমার চা খাওয়া নিয়ে কতোজনই কতো কথা বলে। সর্বশেষ যে কথাটা যোগ হয়েছে তা হলো, আমি নাকি চা খাই-ই চিনি খাওয়া হবে তাই। চিনিহীন চা গলায় ঢালতে ঢালতে টলতে থাকা পায়ে কম্পুর সামনে এসে বসি। একে একে সবগুলো মেসেঞ্জারে লগইন করি, মেইল গুলো খুলে বসি। উঁহু, সব ফকফকা। নতুন কিছু নেই। গত বিশ দিনে সাহারায় হঠাৎ বয়ে যাওয়া সামান্য মরুবাতাসের মতো কেবল একটা মেইলই জ্বলজ্বল করে আসছে। আরএসভিপি ডট কম ডট এইউ থেকে। অকাজের মেইল, জঞ্জালবাক্সে যাবার কথা থাকলেও মেইলটাকে খুলি, প্রতিটা লাইন পড়ি তারপর আবার 'আনরেড' করে রেখে দিই। পরেরবার একই কাজ করি। করছি গত বিশ দিন ধরেই। মেইলটার প্রতিটা শব্দ মুখস্থ হয়ে গেছে। আচ্ছা মুখটা তিতা লাগছে কেনো? আসাম ব্লেন্ডের জন্য! শালার চিনির কৌটা!

এরএসভিপি'র উচ্চারণটা কী! সিলভোপ্লে!! মানে কি দয়াকরুন!
- কে দয়া করবে?

: কে আবার, তনয়া!

- তনয়া, তনয়া কে?

: এহ্, ন্যাকামো করো? তুমি চেন না কে তনয়া?

- সত্যি বলছি, চিনি না। আমার কি তাকে চেনার কথা?

: নয়তো কি? এতোগুলো বছর তার সঙ্গ নিয়ে পার করেছো...!

- আমি পার করেছি তনয়ার সঙ্গ নিয়ে? কি বলছো যা-তা!

: আশ্চর্য! যা-তা বলবো কেনো? তোমার মনে নেই নাকি মনে করতে চাচ্ছো না! ভয় পাচ্ছো, তুমি একটা ভীতু। তুমি কষ্টকে ভয় পাও। তনয়াকে মনে করলে তুমি কষ্ট পাবে, তাই মনে করতে চাইছো না।

- আমি ভীতু না। আমি কোনো তনয়াকে চিনি না। যাকে চিনি না তাকে মনে করে কষ্ট পাবো কেনো!

: তুমি নিজের সঙ্গেই মিথ্যে বলছো।

- মিথ্যে বলবো কেনো? সত্যি বললেই বা তুমি কি ক্ষতি করবে!

: সত্যি বা মিথ্যে- আমি কোনোভাবেই তোমার ক্ষতি করতে পারবো না। আমি তো তুমিই! আমি কেবল তোমার ভুলটা ধরিয়ে দিতে পারবো।

- লাগবে না তোমার ভুল ধরাতে। তুমি যাও। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

: আরেকটু থাকি? এটা একটা প্লীজ!

- থাকতে পারো। কিন্তু তনয়া ফনয়া নিয়ে কথা বলতে পারবে না।

: আচ্ছা ঠিকাছে। চলো তাহলে অন্যকিছু নিয়ে কথা বলি। আচ্ছা তোমার কি সে জায়গাটার কথা মনে আছে? ঐযে অনেক বিস্তীর্ণ হলুদ রঙের মাঝে হঠাৎ বয়ে চলা একটা সরু সাগর...!

- কোন জায়গার কথা বলছো? সাগর আবার সরু হয় কী করে! এমন কোনো আজগুবি জায়গা কি আমার চেনার কথা!

: আশ্চর্য! এটাতো তোমারই প্রিয় জায়গা। তুমি আমাকে জায়গাটার গল্প বলেছো এই সেদিনও। মনে নেই তোমার!

- একদমই মনে পড়ছে না। তুমি কি আমাকে বলবে জায়গাটার কথা!

: আমিতো বলতেই চাই। ঐযে একটা পায়ে চলা সাদা মেঠো পথ। বাহাদুরপুরের কালীবাড়ির বটগাছটার মতো একটা বুড়ো বটগাছ, তার পাশ দিয়ে বেঁকে নেমে গেছে পথটা সরু হয়ে। যেতে যেতে পথটা ক্ষেতের আল হয়ে যায়। অনেকদূর হেঁটে গেলে হলুদ শর্ষে ক্ষেত। যতদূর চোখ যায় কেবল হলুদ আর হলুদ। সেখানে একটা সাগর। খালের মতো সরু। ঘাসময় ঢালু পাড়ে পা ছড়িয়ে বসলে বিছানো হলদে চাদর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। সামনে দিয়ে দুয়েকটা ভটভটি জাহাজ পাল উঁচিয়ে চলে যায়। সেখানে সূর্যের তেজ কম, মৃদু বাতাস বয়, তাতে চামেলীর গন্ধ। তুমি সেখানে বসে থাকো। তোমার পাশে বসে থাকে তনয়া। তোমার হাতে হাত রেখে, তোমার কাঁধে মাথা রেখে....।

- থামো থামো। এমন কোনো জায়গার কথাই তো আমি মনে করতে পারি না। আমি কখনোই এমন একটা জায়গায় যাইনি, তোমাকে গল্প বলবো কোত্থেকে! আমি নিজেই যেখানে যাইনি, সেখানে তনয়া নামের অস্তিত্ব কোথায় পাও তুমি বলতো! আমিতো এই নামে কাউকে মনেই করতে পারছি না!

: তুমি মনে করতে চাচ্ছোনা বলে পারছো না। আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও, তোমাকে তনয়ার গল্প বলি। তুমি মনে করতে পারবে সব। তার হাতভর্তি রেশমি চুড়ি, সে তনয়া। কোমরসমান লম্বা চুল, সে তনয়া। চোখ নাচিয়ে হাসে খিলখিল করে, এক পায়ে পরা নুপুরের কেমন অদ্ভুত শব্দ তুলে দৌড়ে যায় শর্ষে ক্ষেতের আল ধরে, সে-ই তো তনয়া। শুনবে তুমি, শুনবে তনয়ার গল্প?

- না না, আমার এখন সময় নেই। তুমি যাওতো এখন। তনয়ার গল্প শোনার চেয়ে আমার এখন বেরিয়ে পড়া জরুরী। কাজে দেরী হয়ে যাবে নয়তো...!

No comments: