Thursday, April 24, 2008

ভালোবাসা দিবস, ন-হণ্যতে এবং একটি ডোভ মূর্তি

১.

আমরা একই স্কুলে পড়তাম। আমরা মানে আমি, আর সুষ্মিতা। নামে মিতা আর শুরুতে সু শব্দটি থাকলেও সুষ্মিতার মাঝে সুমিতা দেবীর মতোই খান্ডারনী স্বভাবটি রাজত্ব করেছে পুরোটা সময়, তার সুন্দরের সুষম বন্টনকে পাশ কাটিয়ে। আর সুমিত ভাষণ! 'তিনি থাকেন বাংলার প্রমিত ডিকশনারীতে, ভগবানের কৃপায় তাকে সুষ্মিতার শব্দ-পল্লীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর'।
বাংলা শব্দকোষে যে এরকম একটি শব্দ আদতে জলজ্যান্ত বিদ্যমান সেটাই দিব্যি অস্বীকার করে সে আমার চেহারা মুবারক খানা দেখলে।

নাইনে উঠে প্রথমবার সরাসরি কথা বলার আগ পর্যন্ত তার দেড় ক্রোশ দূরে থাকাটাই নিরাপদ মনে করতাম। সেই কথা বলা আর সামাজিক জীব হিসেবে পরিচয় পরিচিতির প্রথম পর্বের পর দূরত্বটা আরো আধাক্রোশ বাড়াতে বাধ্য হই আমি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অসহায় আবেদনে।

"কিন্তু কাহাতক আর! এভাবে তো আর চলে না! এর একটা বিহিত তো অবশ্যই করা লাগে!" - ফ্যারাডের মাথায় যেমন করে বুদ্ধি খেলে গেলো বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগে, ঠিক তেমনি আমার মাথায়ও ময়ূরীর নাচ নেচে গেলো বুদ্ধি!

সন্ধি!

"সাদা নিশান আর সাদা কপোত নিয়ে হাজির হবো তার সামনে। তারপর করজোরে জিজ্ঞাসা করবো এই অধমের প্রতি তার এহেন বিরাগের কী হেতু!" - বন্ধুদের এভাবে প্রস্তাবনাটা জানাতেই সোজা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো।

"এইসব কপোত-ফপোত রাখো মামা। রোমান্টিক কিছু ভাবো। এইসব উত্তম কুমার আমলের কবুতর মার্কা রোমান্সে কাম হইবো না। উল্টা নিজের নাকশার নকশা বদলাইয়া ফিরতে হইতে পারে...!"

আসলেই ভাবনার কথা। কিন্তু বন্ধুরা যেভাবে ভাবছে আমি সেভাবে ভাবতে পারছি না। কারণ অবশ্য আছে বেশ কয়েকটা। তার মধ্যে সবচাইতে ধর্তব্য যে কারণ সেটা হলো, 'আমার হাতে সাত-পাঁচ ভেবে কদম ফেলার পর্যাপ্ত সময় আর অবশিষ্ট নেই!'

এমনি নানা ভাবনার অতলে তলিয়ে যাবার আগেই বাদল বাঁচালো 'বই' নামক বয়া দিয়ে। সবাই সম্মতিও দিলো। পরের ঘটনাগুলোও ঘটে গেলো বেশ দ্রুত। বই কেনা হলো, সেটা আবার রাঙতা কাগজে মোড়ানোও হয়ে গেলো। ঠিক হলো পরদিনই সন্ধির আবেদন করা হবে সুষ্মিতার কাছে, সশরীরে।

ক্লাশ শেষ। বারান্দায় সুষ্মিতাকে দলছুট পেয়ে পাকড়াও করে ঘড়ির কাঁটার হিসেবে পৌণে একদিনের রিহার্সেল দেয়া আবেদনের কথাগুলো তোতাপাখির মতো গরগর করে উগড়ে দিলাম। আমার কথায় ও কি বুঝলো, কি বুঝলোনা সেটা ঠিক বুঝা গেলো না। তবে তার কথা থেকে আমি যা বুঝতে পারলাম তা হলো, 'সন্ধি নিয়ে কথা বলতে হলে সময়ের প্রয়োজন। আর আজকে সেটা সম্ভব না, কাল বিকেলে প্রাইভেট টিউটরের বাসা থেকে বের হয়ে কিছুটা সময় হাতে আছে। তখন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সন্ধি নিয়ে কথা হতে পারে!'

তা হতে পারে বৈকি! এই ভেবেই পরের দিন, নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ের পাক্কা দেড়ঘন্টা আগেই এসে বসে আছি। অংক পরীক্ষার মতো টেনশন হচ্ছে। পাটীগণিতের সুদ-কষায় প্যাচ লাগলে যেমনটা হয়। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা না তো! তবে কি আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কোন জটিল-ভেজাল-সমীকরণের আভাষ দিচ্ছে?

প্রত্যাশিত সময়ের কিছু আগেই সুষ্মিতার দেখা মিললো। কলাপাতা রঙের থ্রী-পিস, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, খুব ধীরে, দৃষ্টিনন্দন ভঙিমায় হেঁটে আসছে এদিকে। হাঁটার এই স্টাইলটি সুস্মিতার একদমই নিজস্ব। সুস্মিতাকে আসতে দেখে নির্জন জায়গাটি যেনো আরো নির্জন হয়ে গেলো হঠাৎ করেই। গাল বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা ঘাম পড়ে গেলো নিচে, অথচ আমার চারপাশে তখন কেমন যেনো শীতল একটা অনুভূতি। আলগোছে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া আমি, নীল রাঙতায় মোড়া সবুজ 'ন-হণ্যতে'টা আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম...।



২.

বিকেলটা একদমই সুবিধার না। সকালটা একটা ঝলমলে দিনের সূচনার কথা বললেও দুপুর থেকেই আকাশের মন চুপশে যেতে শুরু করেছে। যতোটা গর্জায় আকাশ নাকি ততোটা বর্ষায় না, সেটাই আপাতত আশার কথা। না হলে ছোট্ট ছাতায়, মাথা কাকভেজা হওয়া থেকে বাঁচলেও রাধিকার বস্ত্র শেষরক্ষা পাবে না!

উফ, কালকে এই বদ ছোরাটা আমাকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিয়েছিলো একেবারে। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে সামনে এসে খই ভাজার মতো পটপট করে কি সব ঘোড়ার মাথা বলা শুরু করলো! স্কুলের বারান্দায় তার অতর্কিত প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়াটা মোটেই প্রত্যাশিত ছিলো না। ভড়কে যে গিয়েছিলাম সেটা ঢাকার জন্যই তো এই নাকাবন্দী! 'কী হবে, কী বলবে'- এই ভাবনাটা সারাটাক্ষণই তটস্থ করে রেখেছে।

পড়তে আসার আগে নিজের সবচাইতে পছন্দের জামাটা পরেছি। বাসা থেকে বেরুবার আগে ছোট মামার দেয়া আমার সবচাইতে সুন্দর ডোভ মূর্তিটা ব্যাগে নিয়েছি। আচ্ছা, ও উলটা পালটা কিছু করবে নাতো! ধুর, কি সব ভাবছি। ওর চোখ দেখে মনে হয় না ঝামেলা করতে পারে।

কিন্তু যদি এমন কিছু করেই ফেলে তখন! তার চাইতে বোধহয় না গেলেই ভালো হয়। যাহ্, এখনতো মনেহচ্ছে দোটানায় পড়ে গেলাম। একমন বলে যেতে, আরেক মন বলে না যেতে। মহা ঝামেলায় পড়া গেলো তো!

এম্পটি জ্যাকফ্রুট চান্দু, দেখলেই রাগ চিরচিরিয়ে ওঠে। সারাক্ষণ পিন্ডি জ্বালানো আলটপকা মন্তব্য! সেদিন আগ বাড়িয়ে পরিচিত হতে এসেছে। আরে ব্যাটা তোকে তো আমি সেদিন থেকেই চিনি যেদিন স্কুল ফাংশনে গান গাওয়ার রিহার্সেলের পর বলেছিলি, "গলা তো না যেনো ফাটা বাঁশ তাও আবার দুই নম্বর সূই-সূতা দিয়ে সেলাই করা!"

আমাকে আড়ালে সুই-সূতা বলে ক্ষেপাস ব্যাটা বদের হাড্ডি। যেতে ইচ্ছে করছে না একদম। রাগ চড়ে যাচ্ছে। তোর সাথে কোনো সন্ধি নাই, যা ভাগ!

এক সঙ্গে পড়তে আসা মেরী খোঁচা দিয়ে বলে, "কী রে, দাঁত কিড়মিড়িয়ে আছিস কেনো!" আমি হেসে ফেলি, ডে ড্রীম!

যাবো না যাবো না করেও শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের কাছে হার মানতেই হলো। দেখাই যাক না চান্দু কী বলে!

দূর থেকে দেখেই নার্ভাস মনে হচ্ছিলো তাকে। প্রতি সেকেন্ডেই নড়েচড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে যেনো কাঁটার পিড়িতে কেউ জোর করে বসিয়ে দিয়েছে। একটু পরপর সাদা কিছুতে মুখ মুছছে। ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে আছে দেখে হঠাৎই মায়া হলো। আহারে বেচারা! তাড়াহুড়ো করে গেলে ভয় পেয়ে উঠে দৌঁড় লাগাতে পারে। আর আস্তে গেলে নিজের ধুপধুপ আওয়াজটাও একটু নিয়ন্ত্রনে আসবে।



৩.

সুষ্মিতা যেমনি ধীরে হেঁটে এসেছে ঠিক তেমনি ধীরে বসলো, ঠিক যেনো সবুজ রঙের কোনো বার্বির মতো। যেনো কোনোই তাড়া নেই তার। আকাশের অবস্থাও সুবিধার না, সেদিকেও ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। ব্যাগে ছাতা আছে কী না কে জানে! বৃষ্টি মাথায় করে যাওয়াটা নিশ্চই শোভন হবে না পাতলা থ্রী-পিস পরা এক বঙ্গ-ললনার জন্য। গুমোট আবহাওয়ায় ভ্যাপসা গরমে আমার অবস্থা তথৈবচ। জামা ভিজে চুপচুপ করছে, আসার পথে কেনা সুগন্ধি টিস্যুর প্যাকেটেও শেষ কয়েকটা আছে। ওগুলো দিয়ে ঘাম মুছে ফেললে সন্ধির সাদা নিশান পাবো কই! পরিস্থিতি বিগড়ে যাবার আগেই বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজটা সেরে ফেলা উচিৎ। 'ওহ্ গড আই ডোন্ট হ্যাভ এনাফ টাইম ফর দ্যাট!'



৪.

অনেকক্ষণ হয়ে গেলো কেউ ই কোনো কথা বলছি না। বরফ ভাঙলো সাগর নিজেই। 'ফ্যাঁ'র প্যাকেট থেকে একটা সাদা টিস্যু বের করতেই জুঁই ফুলের মাতাল করা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। টিস্যুটি আমার সামনে বিছিয়ে বললো, "এইযে সাদা কেতন! চলো এবার সন্ধি করি..."

আমার কেনো যেনো খুব হাসি পেলো। সাগরের বলার ভঙিটার কারণেই বোধহয়। হেসে তার টিস্যুটি কুড়িয়ে নিয়ে বললাম, "না থাক। তার চাইতে চলো গল্প করি! সন্ধি করা লাগবে না, ঝগড়া মিটমাট!" মনে মনে ভাবি, তুমি ডাকতে এতো দেরী করলে কেনো বোকা ছেলে!

হালকা-মজার গল্পে মনের ভেতরে পুষে রাখা রাগটা উবে চলে যায় সাগরের ওপর থেকে। এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা বোধহয় ঠিক হবে না আর। যেকোনো মুহূর্তেই ঝুপ করে নেমে আসতে পারে বৃষ্টি। কয়েক ফোঁটা ইতোমধ্যেই টুপাটুপ আদর করে গেছে ধরনীকে। সাগরকে বলতে সেও মাথা নেড়ে সায় দিলো। "চলো তবে ওঠা যাক"- বলেই তড়াক করে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি ব্যাগ থেকে সাদা ডোভ মূর্তিটা হাতে নিয়ে, দাঁড়িয়ে সেটা সাগরের দিকে বাড়িয়ে বলি, "নাও এটা তোমার জন্য। আমার সবচেয়ে প্রিয়...।"

সাগর মনে হয় প্রস্তুত ছিলো না এর জন্য। ওর হা করা মুখটাও দেখার মতো ছিলো। খুব হাসি পাচ্ছিলো আমার বেচারার করুণ চেহারা দেখে! কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি নির্ঘ্যাৎ। 'ওহে তব্দা খাওয়া বালক, স্বয়ং বিধাতাই নারীর মন বোঝেনি, তুমিতো এক নগণ্য আদম সন্তান!'



৫.

সুষ্মিতা আমাকে অবাক করে দিয়ে যে ডোভ মূর্তিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো সেটা বিখ্যাত এক শহরের পাবলিক স্কয়ারে রাখা ভাস্কর্য। প্রেমের শহরে, ভালোবাসার নিদর্শন বুঝায় অপ্সরার মাথা ওয়ালা এই ডোভটি। সেই শহরের ঐতিহ্য অনুযায়ী 'ডোভ মূর্তিটি উপহার হিসেবে দেয়া মানে প্রেম নিবেদন' - এই কথাটা কি বোকা মেয়েটা জানে!

জেনে দিক, আর না জেনেই দিক। এখন তো মনে হয় আমারও কিছু দেয়া উচিৎ তাকে। কিন্তু কীভাবে যে দিই!

ছাতা খুলে ধরা সুষ্মিতাকে বললাম, "তুমি কি চোখ দু'টো একটু সময়ের জন্য বন্ধ করবে প্লীজ। আর হ্যাঁ, আমি না বলা পর্যন্ত খুলবে না- এটাও একটা প্লীজ...!"



৬.

সাগরের হাতে সেই তখন থেকেই একটা নীল প্যাকেট দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার জন্যই এনে থাকবে হয়তো, অথচ দিচ্ছে না! প্যাকেটটা আমার জন্যই কী না, সেটাও জিজ্ঞেস করতে পারছি না। এমনওতো হতে পারে তাকে আজকের দিনে অন্যকেউ দিয়েছে, কিংবা সে কাউকে দিতে এনেছে! অন্যকারো জন্য হলে, তখন লজ্জা পাবো ভীষন। তার চেয়ে কৌতুহল অবদমন করে রাখাই শ্রেয়। ওর চোখ বন্ধ করার অনুরোধ আর অনুরোধের ধরণ শুনে আরও এক পশলা হাসি পেলো। হাসি মুখেই চোখ বন্ধ করলাম, জোরে, হাত সামনে বাড়িয়ে...!

এক মুহূর্ত- দুই মুহূর্ত- তিন মুহূর্ত!

কী ব্যাপার ব্যাটা কিছু দেয় না কেনো হাতে! কী ভাবছে তাই চিন্তা করছি। 'আরে ব্যাটা দিবিই যখন দিয়ে দে, আর কতোক্ষণ আন্ধা বানিয়ে রাখবি!'

চার মুহূর্ত- পাঁচ মুহূর্ত- ছয় মুহূর্ত- হঠাৎ...!

মুখের ওপর উষ্ণ এক চাপ অনুভব করলাম আমি। উষ্ণ-ভেজা চাপ। আমার দম বন্ধ হয়ে এলো, সারা শরীর শিউরে উঠলো। পা টলে উঠলো, যেনো সমস্ত শক্তি হুট করে চলে গেলো আমাকে ছেড়ে। কাঁধ থেকে ব্যাগটা টুপ করে পড়ে গেলো, নিজেকে হঠাৎই খুব হালকা মনে হলো, খুবই! যেনো বকের পালকের মতো আমি ভেসে যাচ্ছি... ভেসে যাচ্ছি বাতাসে দোল খেতে খেতে...!

অনুভব করলাম, সাগরের হাত আমার হাতটা টেনে ধরেছে। শক্ত কিছু একটা ধরিয়ে দিয়ে কানের কাছে ফিশফিশ করে বললো, "ভালো থেকো তবে!"

ভালোলাগা নেশায় আরও কিছুক্ষণ ডুবে থেকে চোখ খুললাম। সাগর তখনো চোখের আড়াল হয়ে যায় নি। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। হাতের নীল রাঙতা মোড়ানো প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করি, "বেকুবটা কি জানতো আজ ফেব্রুয়ারীর কতো তারিখ!"



৭.

এই বৃষ্টিস্নাত বিকেলটাই নিজবাসভূমে সাগরের কৈশোর জীবনের ইতি। সে রাতেই পশ্চিমাগামী এক উড়ানে চেপে বসে সে। পশ্চিমেই হবে তার বাকী পড়াশুনা, আলাদা হয়ে যাওয়া বাবা-মা, মেঝো চাচার এটাই ইচ্ছা। সাগরের ইচ্ছেটাও ওরকমই ছিলো। বাবা-মার থেকে অনেক দূরে থাকতে পারলেই সে বাঁচে। কিন্তু এখন মাঝরাতের কোন উড়ানের উইন্ডো সীটে বসে, পাশের কাঁচের জানালার ওপাশে গড়িয়ে পড়া পানির সর্পিল রেখা দেখতে দেখতে সাগরের অদম্য ইচ্ছে হয় ছুটে বেরিয়ে যায় এই উড়ান থেকে। এক ভোঁ-দৌঁড়ে চলে যায় বন্দর ছেড়ে।

উড়ান চলতে শুরু করে, সাগরের কিশোর বুকটা দুমড়ে যেতে থাকে যেনো উড়ানের চাকাগুলো গড়ায় সেখানেই। লুকিয়ে হাতের উলটো পাশে চোখ মুছে সাগর। পাশে বসা মেঝো চাচা মাথায় হাত বুলিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলেন, "বাবা-মার কথা মনে পড়ছে খুব, না রে!"
সাগর ইয়ার ফোনের প্লাগটা কানে গুঁজে দেয়। ৬ নম্বর স্টেশন থেকে মস্তিষ্কে সোজা আঘাত করে হিউম্যান নেচার। সামটাইমস আই উইশ দ্যাট আই কুড টার্ণ ব্যাক টাইম...



৮.
সুষ্মিতা ঘোরে থেকেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো চোখ খুলে দেখতে পায় সাগর হেঁটে অনেকটা দূর চলে গেছে। সাগরের চলে যাওয়াটা উপলব্ধি করার অবস্থায় সে তখনও আসেনি। ঠিক এই মুহূর্তে সুষ্মিতার মনে হয় তার চাইতে সুখী আর কেউ নেই। শিরা-উপশিরা গুলো অদ্ভুত এক চঞ্চল আনন্দ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার সারা শরীরে। চারপাশের সবকিছুই অসম্ভব ভালো লাগতে শুরু করে। মুখে মিষ্টি একটা স্বাদ লেগে আছে। ব্যাগটা আস্তে করে তুলে নিয়ে, নীল রাঙতা মোড়ানো প্যাকেটটা শক্ত হাতে ধরে সে ঘরে ফিরে আসে।

অনেক রাতে টেবিল ল্যাম্পের মৃদু-মায়াবী আলোয় প্যাকেটটা খোলে সুষ্মিতা। ন-হণ্যতে।
সাদা জায়গায় গাঢ় সবুজ কালিতে সাগরের হাতের লেখা- "তোমাকেই দিলাম"। বইটা হাতে নিয়ে সুষ্মিতা উল্টে-পাল্টে দেখে, নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেয়, চোখ বন্ধ করে বিকেলের সেই পাগল করা অনুভবটা পেতে চেষ্টা করে আবার। সাগর- তার হাত- লম্বা লম্বা আঙুল- সুষ্মিতার চোখ বন্ধ- মুখে উষ্ণ তীব্র চাপের ভেজা স্পর্শ!



শেষ.

সুষ্মিতার জানালার বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, বাইরে থেকে জানালায় কান পাতলে ভেতর থেকে খুব আবছা আওয়াজে ঈগলসে'র 'লাভ উইল কীপ আস এ্যালাইভ' গানটা ভেসে আসে। সুষ্মিতার জানালা থেকে সরে আসার সময় কাছেই কোথাও হঠাৎ বজ্রপাতের তীব্র শব্দ হয়। নীলচে আলোয় ভরে ওঠে চারদিক। সুষ্মিতা-সাগরের জন্য আকাশের যেনো অনেক কষ্ট, সেই কষ্টেই বুঝি নীল হয়ে যাচ্ছে সে বারবার।

সুষ্মিতা জানলো না এই গল্পটির পথ কোন দিকে যাবে, কোথায় গিয়ে শেষ হবে এই গল্প!

সাগর ও সুস্মিতার এর মাঝে আর কখনোই দেখা হয়নি, কথা হয়নি, যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে তারা একই শহরে বাস করে, তাদের হঠাৎ দেখাও হয়ে যায়, কিন্তু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, বড্ড ভুল সময়ে। অপ্সরার মাথা ওয়ালা বিশাল ডোভ মূর্তিটির নীচে ঝিরঝির বৃষ্টির মাঝে অনবরত কথা বলতে থাকা ফুটফুটে একটি বাচ্চা মেয়ের তুলার মতো নরম হাত ধরে, সাগর দাঁড়িয়ে দেখে, সেদিনের সেই কলাপাতা রঙের সুস্মিতার পাশে আজ অন্য কেউ, অন্য কোনো প্রয়োজনে!

"ড্যা-ডি, হোয়েন উইল উই গো টু মাম্মী!"

কথা বলা পুতুলটির টানে সম্বিৎ ফিরে পায় সাগর। স্টেফানী, অনেক ভালোবাসতো তাকে। প্রতি সপ্তাহের এই দিনে মেয়েকে নিয়ে সে বউয়ের কবরের দিকে যায়!

No comments: