Sunday, January 27, 2008

ইনহাস্ত ওয়াতানাম

'তোর জন্য আমার মনটা পুড়ে। কলজেটা খা খা করে। বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে বারবার- এইটা বুঝস? তারপরেও বলবি আমি তোরে মনে রাখি নাই! আমার প্রতিটা মুহূর্ত ক্যামনে যায় সেইটা কেবল আমিই জানি। চোখের পানি লুকাতে বুকে যে খরস্রোতা নদীর ভাঙন খেলে এইটা আমি কারে বলি!... ... ...'

আমার মা, দুষ্টামী করে আমাকে ভুলে গেছে কি না জিজ্ঞেস করতেই এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো উগড়ে দিলো দূরালাপনীর ভেসে আসা কম্পনগুলোতে। শেষের দিকে এসে আর স্বাভাবিক রাখতে পারেনি নিজেকে। কাঁপা গলায় ভেজা আওয়াজে ফোশফোশ করছিলো। আমি সন্তর্পণে চোখ মুছি, গলা স্বাভাবিক রেখেই বাৎচিত চালাতে হয়। আমার সামান্যতম দুর্বলতা টের পেলেই ওইদিকে ভেঙে পড়বে শতবছরের পুরনো বাঁধ। তখন হয়তো প্রয়ঙ্করী বাণটাকে আর আটকানো সম্ভব হবেনা কিছুতেই!

একাকীত্বকে আমি সবসময়ই উপভোগ করি। আমি কোনকিছুরই দাস নই। কিন্তু তাও সয়ে গেছে মা-বাপ, ভাইদের ছেড়ে থাকতে থাকতে। শুধু কয়েকটা সময় হুটহাট করে সব তেড়ে আসে প্রবল তোড়ে আমার শীর্ণ দুয়ারে আঘাত করতে থাকে। এমনই একটা সময়, যখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। মাকে খুব মনে পড়তে থাকে তখন। স্কুল কামাইয়ের লোভে যখন ইচ্ছে করে জ্বর বাঁধিয়ে বসতাম মা তখন মাথায় জলপট্টি দিয়ে এক নিঃশ্বাসে বকাঝকা করতো। আমি মিটিমিটি হাসতাম, নানা খাবারের বায়না ধরতাম। মা তখন বিশাল একঝাপি গালি আমার মাথায় ঢেলে দিয়ে পছন্দের সবকিছু বানিয়ে মুখের সামনে তুলে ধরতো। খেতে পারতাম না কিছুই তিতা রসনার কারণে। এই আমি গত একসপ্তায় কিছুই খাইনি। না তেতো স্বাদের জন্য নয়, ঘরে কিছু বানানোর ছিলো না তাও নয়, কিন্তু উঠে রান্নাঘর পর্যন্ত যাওয়া আর সব যোগাড়যন্ত করে উনুনে চড়ানোটা বেশ অতীতের কাজ মনে হচ্ছিলো। বাইরে খাওয়ার রূচি নেই। খাবার দেখলেই বমিচ্ছা হয়। বুকের ভেতর থেকে আস্তে করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে, মা থাকলে নিশ্চই খাওয়ার এই কষ্টটা করতে হতো না। ঠিকই কি মুখে রচবে, এমন কিছু চলে আসতো চোখের সামনে। খেতে হতো জোর করেই!

বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলো। আমার একটাই মাত্র বড় ভাই। তার বিয়েতে যাওয়া হলো না, খুব ছোটবেলা থেকে ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে বুণা স্বপ্নগুলো শেষাবধি আর মালা হতে পারলো না। আমার কষ্টটা আরো বেশী লাগার কারণ মা খুব কেঁদেছে তাঁর মেজো ছেলে না থাকাতে। আমি মাকে কী করে বুঝাই, 'মাগো তোমার ছেলের যে যাযাবর হওয়ার শখে পেয়েছে...'।

ফোনে কথা বলছি, দুষ্টামী করছি, হাসছি- মা হঠাৎ বলে ওঠে 'তুই কি খুশীতেই হাসতেছিস নাকি নিজের কষ্টটা লুকানোর জন্য!' মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে যাই, বাকহারা আমার আর রা' সরে না। প্রসঙ্গ পালটাই, ছোট মামার পিচ্চিটা বড় হয়ে যাচ্ছে। কটকট করে কথা বলে এখন। প্যান্ডা পেয়ে খুব খুশী হয়েছে।

গ্রামেই কেটেছে বেশিরভাগ সময়। গ্রামকেও চিনি তাই অনেক বেশি শহরের তুলনায়। চিনি গ্রামের মানুষগুলোকে। উপলব্ধি করতে পারি গ্রামের গন্ধটাকে। ষড়ঋতুর দেশে বৈচিত্র কমে গেলেও গ্রীষ্মের গন্ধের সঙ্গে যে বর্ষার গন্ধ কোনমতেই খাপ খায়না এটা বুঝতে পারি। শরৎ আর শীতের গন্ধেও তফাৎটা বিশাল। আমি থাউজেন্ডস মাইল দূরে উষ্ণ কক্ষের নরম বিছানায় শুয়েও গন্ধ গুলোকে উপলব্ধি করতে পারি। প্রতিটা ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথেই মাটির রং, রস গন্ধও বদলায়। আমি সেই গন্ধ সারা গায়ে মেখে ইট-পাথরের বাধাই করা পথে দৌঁড়াই। ছোটভাইকে ফোন ধরে বিভিন্ন রাস্তা ধরে হাঁটতে বলি, আমি বলে বলে দেই ও কখন কোন বাঁশঝারের কাছ দিয়ে যাচ্ছে, এই মাত্র রাস্তার কোন মোড়টি বাঁক নিলো সে, আমি এখানে বসে বলে দেই। ভাই অবাক হয় না, এটা যেনো জানারই কথা; কিংবা অবাক হলেও জিনোটাইপের কারণে সেটা প্রকাশ করে না।

আমার খুব ইচ্ছে করে মূলহীন জীবনের ইতি টেনে ফিরে যাই আমার মায়ের কাছে। অনিশ্চয়তার কোলে সঁপে দিই নিজেকে। কী হবে, যেখানে আর বারো কোটি মানুষ বেঁচে আছে সেখানে আমি কি বেঁচে থাকবো না! হোক না ছাপোষা, তাও তো অসুস্থ হয়ে পড়লে কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা মেপে দেখার মতো কেউ থাকবে আশে পাশে। না থাকুক সেখানে রঙীন দামী নোটের কড়কড়ানি, অন্তত ম্যাড়ম্যাড়ে কয়েকটা পুরনো ময়লা পঞ্চাশ টাকার নোট তো হাতে গুজে দিবে কেউ। তাতেই খুশী আমি। আমার আর ভালো লাগে না সৃষ্টিহীন এই দিনাতিপাত, আর ভালো লাগে না অভব্য এই ইঁদুর দৌঁড়। মা-মাটি-মাতৃভূমি, যেমনই হোক- যেমনি থাকি সেই তো আমার জন্মভূমি।

Friday, January 25, 2008

লেখার এলোমেলো ড্রাফট ১৩

লাক ব্যাপারটা ছেড়ে গেছে, কয়েকযুগ হবে- আনলাকটাকেই আকড়ে ধরে আলগোছে পাড়ি দেয়া পথ। মাথার ভেতর ফ্লোরার মূর্ছনা মুহূর্তেই জিউসের অগ্নিতাহূতিতে হারিয়ে যায়। টনটন ব্যাথায় সটান হয়ে ওঠে শিরা উপশিরাগুলো। শান্তির নীড়ে মাথা কুড়েও কিছু মেলেনা। অন্তরাবাদ্যি শূন্যে ঢাক পেটায়। রেডিও থেকে হিউমারাস হয়ে আলনায় এসে দোলা লাগে প্রলয়ঙ্করী তুষারঝরের। ব্যাথাতুর কোটরে অস্থির অক্ষিগোলকের পায়চারী শুরু হয়। গাঁয়ের পথে ছুঁটে বেড়ায় অবিরাম। মাঠ-ঘাট-সরষে ক্ষেত পেরিয়ে পাঁচিলঘেরা একটি বাড়ির সামনে এসে থামে। সশব্দে লোহার দরোজাটি খুলে যায় ধীরে ধীরে। অস্বস্তি হয়, ভয় হয় অন্দরে যেতে। যাযাবরী জীবনের ইতি টানতে সাধ এখনি জাগে না। কিন্তু মাগো, বড় যে একা একা লাগে আমার...!

Friday, January 18, 2008

স্বদেশ যাত্রার ইতিকথা

ডিএম, শ্লেকার, কারস্টাড্ট, কাউফহফ এবং অবশেষে লিডেল ঘুরে, তাদের ব্যবসায়িক লাভের সমুদ্রে বিন্দু পরিমান জলদান করে ঘরে ফিরে প্যাক করার সময় বাধলো আসল বিপত্তি।

এথনিক প্যাসেঞ্জার হিসেবে ৩৫ কিলো পাওয়া গেলো বটে কিন্তু আধা ঘন্টায় লাগেজ গুছিয়ে সেটা ওজন দেয়ার পর চল্লিশ ছাড়িয়ে গেলো! তারওপর এখনো একটা ছোট ব্যাগ পাল্লায় তোলা হয়নি। হাতে থাকার কথা ল্যাপটপের ব্যাগটাও। খালাতো ভাইয়ের দশ কিলো আসবে এয়ারপোর্টে! কী রেখে কী নেই, এই চিন্তায় মাথার ভনভন কাটাতে ঢুঁ মারি সচলে, সামহোয়ারে, পেপার পড়ি, গান শুনি, এক দুই টুকরা টম এন্ড জেরী দেখি- খো খো করে হাসি, কিন্তু পরিত্রাণের উপায় আর পাই না।

সব খুলে আবার ঢুকালাম এক এক করে, একেবারে ওজন মেপে। যা না নিলেই নয়, সেটা কমে দাঁড়ালো ২৪ কিলোতে। বাকিগুলো ঢুকানো হলো আলাদা ব্যাগে। খালাতো ভাইয়ের দশ কিলো সাঁটিয়ে যতটুকু নেয়া যায় যাবে, বাকিটুকু থেকে যাবে। এই আশায় একটা পিঠব্যাগও স্ট্যান্ডবাই রাখা হলো। তিন ঘন্টা ঘুমিয়ে লাল লাল চোখে, ঢুলুঢুলু আমেজে আইসিইতে একটানে ফ্রাঙ্কফুর্ট।

আমার জীবনে ফ্লাইটের এতো আগে কখনো এয়ারপোর্টে যাওয়ার রেকর্ড নেই। সময় মারার জন্য এদিক ওদিক ঘুরি, এটা সেটা দেখি, খাই- ইত্যাদি।

খালাতো ভাই এলে তার জিনিষ ঢুকিয়ে জিনিষ পত্তর শাফল-রিশাফল করে চেকইনে গিয়ে দেখা গেলো ৪৯ কিলো+। পিঠে তখনো সাড়ে পাঁচ কিলোর ব্যাগটা পড়ে আছে। পড়বি তো পড় একেবারে দজ্জাল মহিলাটার কাছেই গিয়ে পড়লো সিরিয়াল। মহিলা কোন কথাই শুনতে রাজী নন। 'তিনি সবই জানেন' কিন্তু 'ওজন কমান' ছাড়া কিছুতেই আপোষ করতে রাজী নন। দিলো ফিরিয়ে। এইবার তিন মাথা বসে নানা ফন্দি আঁটি। ফলিত কাজ কিছুই হয় না। মাথায় কি চিন্তা আসতেই ব্যাগ থেকে কাপড় খুললাম, ল্যাপটপের ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ তার কেবল, চার্জারসহ বের করলাম। এবার আবার নিলাম মহিলার কাছে। তিনি দেখলেন, ৪৩,৫- 'হুঁ, এবার ঠিকাছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশী জিনিষ নিতে পারবেন না এবং কোন জিনিষ আর ঢুকাতেও পারবেন না।' টিকিট, বোর্ডিং কার্ডে লিখে দিলেন নিজের তেলাপোকা মার্কা হাতের লেখায়, 'কেবল ল্যাপটপ; অন্য কোন হাতে বহনযোগ্য বস্তা নয়'!

এবার আবার মাথা চুলকানী। এখন কী হবে। আমি ফলিত তত্ত্বে বিশ্বাসী। মুহূর্তেই ল্যাপটপের ব্যাগখানা ফুলে ঢোল হয়ে গেলো। স্ট্যান্ডবাই থাকা পিঠের বস্তাটিও পিঠে ঝুলিয়ে দিয়ে বললাম, 'ওকে, হ্যাভ এ নাইস জার্ণী!'

'আছি এখানেই, সমস্যা করলে এসে ব্যাগ ফেরৎ দিয়ে যেও'- ঠেলেঠুলে ছোটভাইকে পাঠিয়ে দিলাম ইমিগ্রেশনে।
আধাঘন্টা পর এসে ফুচকি দিয়ে জানালো সবঠিকঠাক। এখানে ঝামেলা হয় নি। 'দৌড়ের উপরে থাক'- শুনেই টংটং করতে করতে হাঁটা দিলো ভেতরের দিকে। একটু পর ফোন করে জানালো বোর্ডিং পাস পাইছে, ঝামেলা হয় নি। আমি মনে মনে হিসাব করলাম, ৪৯ যোগ সাড়ে পাঁচ সমান সমান সাড়ে চুয়ান্ন কিলো! সাব্বাশ!!

Friday, January 11, 2008

ইজ্জতের ফালুদা, ডাক্তারবাড়ির সুন্দরীনামা এবং কেছকি মাছ


দুই তারিখে একটা খাইষ্টা সময়ে ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো। নির্ধারিত সময়ের পনেরো মিনিট পর লাল লাল চোখ, উষ্কোখুষ্কো চুল নিয়ে রিসেপশনের সুন্দরী সহকারীর দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিতেই বললো ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে। খানিকটা ঝিমিয়ে নেয়া যাবে, এই উদ্দেশ্য নিয়ে বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা আর যথাযোগ্য গাম্ভীর্যতায় যেই না পা মেলে, গা এলিয়ে চোখ বুজেছি, অমি ডাক্তারের পুতুল পুতুল সহকারীনী এসে তাড়া দিলো। আমিও কার্টুন ছবির কোন চরিত্রের মতো ট্যাং ট্যাং করে তাকে ফলো করলাম।


আমাকে বদ্ধকুঠুরীর মাঝে পুরে, সোয়েটার, শার্ট, টি-শার্ট এমনকি আমার স্যান্ডো পর্যন্ত খুলিয়েও সে ক্ষান্ত হলো না। একখানা খালি বিছানা দেখিয়ে আমাকে সেখানে শায়িত হয়তেও নির্দেশ দিলো। আমি হতভাগা, এই পরবাস জার্মান দেশে এসে নিজের হাতেই নিজের ইজ্জতের এভাবে ফালুদা হওয়ার চাক্ষুস সাক্ষী বণার প্রহর গুণতে লাগলাম।


আমার শত গাঁইগুঁই উপেক্ষা করে সে কম করে হলেও কয়েক গ্যালন রক্ত নিয়েছে আমার নগ্ন বাহু থেকে। একবার ভেবেছি উঠে দৌঁড়ে বাঁচি এই অত্যাচার থেকে, কিন্তু বংশের মুখে চুনকালি মাখার কথা চিন্তা করে, নিরস্ত করলাম নিজেকে। ড্রাকুলার মতো চুকচুক করে কয়েক ড্রাম রক্ত নেবার পর কতোগুলো সাপের মতো লিকলিকে জিনিষের ফোঁসফোঁস করা মাথা গুলো চুম্বকের মতো আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফিট করে দিলো। কাতুকুতু লেগে আমি হেসে উঠতেই 'হুঁশ' করে নড়াচড়া না করে মরার মতো পড়ে থাকতে বললো। মিনিট পাঁচেক বাদে তার এই যন্ত্রণাদানের পরিসমাপ্তিতে আকর্ণ বিস্তৃত হাসিতে বললাম, 'ঈদ মোবারক'। ললনা পুতলা মার্কা একটা হাসি দিয়ে 'ডাংকে' বলে চলে গেলো। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, 'ঈশ অল্পতে চোখটা বাচছে। ইজ্জত গেলে পাইতাম কই আমি!'


এক্সরে-র ব্যবস্থা না থাকায় পাঠিয়েছিলো অন্যখানে। ওখানে গিয়ে আরও ক্যাচালের শামিল। প্লাস্টিক চেহারার এক ললনা এসে আমাকে আধা-অন্ধকার ঘরে যে কি করলো কতোক্ষণ। ছিঃছিঃ, লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায় এগুলা বলতে।


কালকে ছিলো ডাক্তারের কাছে ফিরতি অ্যাপয়েন্টমেন্ট। কৃতকর্মের ফলাফল জানানোর। আমাকে সামনে রেখে ডাক্তার বাবু এই ফাইল ঘাঁটেন, ঐ ফাইল ঘাঁটেন, খানিক কম্প্যুটারে উঁকি মারেন, কতোক্ষণ থুতনী খাউজান, আমার দিকে যখনই দেখেন আমি দাঁত বের করে একটা অসহায় গ্লুকোজ হাসি দিয়ে দেই। বেচারা খানিক্ষণ ঘটনাগুলোর লুপ চালিয়ে হঠাৎই 'গো-টু' কমান্ড ব্যবহার করে বসলেন। আমাকে বললেন, 'কোথাও তো কোন গ্যাঞ্জাম নেই। তাইলে সমস্যটা কি?'খানিক ইতং বিতং করে যেই বললেন সিগারেট ছাড়লে ভালো হয়। অমনি আমি তাকালাম বাঁকা চোখে। নেহায়েৎ ভদ্রলোক তিনি, নিজেকে শুধরে নিলেন, 'না না আমি বলেছি রিডিউস করতে, ছাড়তে না!'


কানের পরে একগাঁদা উপদেশের বানী নিয়ে রিসেপশনের পুতুল পুতুল মুখ গুলোকে পুনরায় দেখা হবার আশ্বাস জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। অনেক হলো, এবার কেছকি মাছ খাওয়ার প্রজেক্ট হাতে নেবার বাসনা পোষন করলাম।


পরিকল্পনা মোতাবেক মৎস কেনা হলো এবং রন্ধিত হলো। মোবাইলটা তখন হাতের কাছে না থাকায় রন্ধনপ্রণালীর সচিত্র বর্ণনা করা গেলো না। সেটা তোলা থাকলো খাদকায়তনের কম্পিটিশনে এবং পরবর্তী বারের জন্য।

ভক্ষণের অপেক্ষায় কেছকি

কোলেস্টেরল বাড়ুক আর না বাড়ুক, গরু খাওয়া আপাতত বন্ধ। এই ক'দিন মৎসের উপর দিয়ে চালাবো কীর্তন। পরিশেষে জয় মা শাকসব্জি! ততোদিন পর্যন্ত খানিকটা মাংশাসী হয়েই থাকি না হয়!

Tuesday, January 08, 2008

উইম্পির চিকেন ব্রোস্ট, মাধুরী দীক্ষিত এবং একটি ট্র্যাজিডি

আমার মতি মামা। বয়সে আমার প্রায় সমবয়সী। হাতে গুণে আড়াই বছরের বড়। সম্পর্কের দূরত্ব তাই হেরে গেছে বয়সের কাছে। আমরা বরাবরই বন্ধু সুলভ। মামা-ভাগ্নে সম্পর্কের বেড়াজালে আমরা একে অপরকে আবদ্ধ করে রাখিনি কখনোই। তাই আমাদের মধ্যে চলে এলাকার গন্ডি পেরিয়ে বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে দুজনেই গলাগলি করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা মামার তৎকালীন প্রেমিকার জন্য। মামা নীপোবনে প্রেমিকার সৌন্দর্য বয়ান করে আর আমি দূর থেকে পাহারা দেই। বিনিময়ে পাই স্কুল ফাঁকি দেবার অপরাধে বাড়িতে না-নালিশীর অঙ্গীকার। উপরি হিসেবে জুটে বাবুলের দোকানে ভরপেট ডাল-ভাজি সহযোগে পরোটা খাওয়ার সৌভাগ্য।

মতি মামার ভাগ্নে হিসেবে তাঁর বান্ধবী মহলে আমার খাতির ছিলো এক্সট্রা। মন্দ লোকে বলে, মামা নাকি এক সঙ্গে কয়েকটা প্রেম চালায় প্যারালাল। বান্ধবী মহলের প্রশ্নবাণে আমি বলি, 'মতি মামার মতো লোকই হয় না। সে তো কেবল আপনার নামই আমার কাছে জঁপে দিবস-রাত্রি!'মামার প্রেমিকা খোশ, মামাও খোশ, আমার পেট ও পিঠ দুইই খোশ!

দিন যায়, রাত ঘনিয়ে আসে। ঘুরে মাস যায়, মাস ঘুরে পেরোয় বছর। আমাদের পদদলনের হাত থেকে রক্ষা পায় গ্রাম। দুরুম দারুম চারণ শুরু হয় রাজধানীর বুকে। আগে যে মতি মামা দাঁড়িয়ে থাকতো বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে, এখন সে অপেক্ষা করে ইডেনের সামনে। আর আমি যে ছাপোষা ছিলাম, সেই ছাপোষাই থেকে যাই। পাহারাদার! তবে দুষ্টুমীতে সামান্য শিল্পের ছোঁয়া লেগেছে। মামার বান্ধবীদের কেবল মিষ্ট কথাতেই তুষ্ট রাখি না বরং সাথে প্রোক্সিও দেই। মামাও নির্দ্বিধায় চালিয়ে যান প্যারালাল ডেটিং।

মতি মামা এখন আর আগের মতো পকেটউদার নন। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পকেট খরচ পান হিসাব করে। আমার পেছনে তাই প্রতিটি টাকা খরচ করার আগে অন্তত আড়াইবার ভাবেন টাকাটা তিনি জলে ফেলছেন কী না। মন্দ লোকে কিছু না বললেও আমি ঠিকই বলি, 'মামা তুমি কিপ্টা হয়ে গেছো। নিজের ভাগ্নেকে কয়েকটা টাকা দিবে তাও ভাবতে হয় তোমার। ছিঃ, মামা ছিঃ। তুমি মামা নামের কলঙ্ক। তোমার টাকা ইন্দুরে খাবে, কেঁচো খাবে, কুত্তা বিলাই সবে খাবে, কিন্তু আমি খাবো না! যাও চাইনা তোমার টাকা'।

মতি মামা হুঙ্কার দিয়ে বলেন, 'অ্যাঁএএ, যা ভাগ হতচ্ছারা। পরশুদিন যে চিঠিটা নাসরিনকে দিতে বললাম, দিয়েতো এলি শারমিনকে। তারওপর শুনলাম তোকে নাকি আজকাল আমার বান্ধবীদের সঙ্গেই বেশিরভাগ দেখা যায়। কিছু বুঝিনা আমি মনে করেছিস বদমাশ। মামার উপর বাটপারী আবার দিস হুমকি! দুধ কলা খাইয়ে আমি কালো সাপ পুষেছি এতোদিন'।

মামার মেজাজ নবমে অনুধাবন করে মানে মানে কেটে পড়লাম তখন। পাছে কেঁচো খুড়তে গিয়ে মামার হাতে অজগরের লেজটি এসে পরে! দু'দিন পর অবশ্য মামা নিজেই 'মিটমাট' করতে এলেন। আরে শোন, 'তুই পোলাপান মানুষ, টাকাতো তুই চাইতেই পারিস। কি জানিস, মেজাজটা ভালো ছিলো নারে। বুঝিসইতো তুই সব!'আমি মাথা নাড়ি, এবং উপলব্ধি কারি- মামার নোঙ্গর নতুন ঘাটে পড়ার অপেক্ষায়!

- চল তোকে উইম্পিতে খাওয়াবো।

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি না। মামার খোঁচানীতে অবশেষে এমটিভিতে 'মাধুরী দীক্ষিত - স্পেশাল মোমেন্টস' রেখেও উঠতে হয়। গন্তব্যঃ কামাল আতাতুর্ক এ্যাভেনিউ।

এখানে সামান্য কথা বলে রাখি। বিবাহের পাত্রী হিসেবে মামা এবং আমি- উভয়ের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে যার অবস্থান সে মাধুরী দীক্ষিত। মামা মৃত্যুর পর নরকে যেতেও রাজী কারণ মাধুরীর স্থান হবে নিঃসন্দেহে সেখানে। ইহলোকে না পেলেও পরলোকে নরকবাসী হয়েও মামার মাধুরীকে চাই। মামার বহুবালিকা গমনে এই থিয়োরিটাই কাজ করে বলে জানি। সবার মাঝেই মাধুরীকে খোঁজেন তিনি। না পেয়ে হতাশ হয়ে ষড়ঋতুর দেশের আমার মতি মামা ঋতুর মতোই প্রতি দু'মাস অন্তর অন্তর বান্ধবী পাল্টান। আমি অবশ্য এতোটা না। 'থাকতে যদি না পাই তারে, চাইনা মরিলে...' গানটা ঘোরে আমার গলায়, এর বেশী কিছু না।

উইম্পিতে চিকেন ব্রোস্ট, মিডিয়াম আলুভাজা আর বড় কোকের বোতলকে সাক্ষী রেখে আমাদের মাধুরী বন্দনা জমে ওঠে। তেজাব থেকে মাধুরী কী করে উঠে এলো আজকের অবস্থানে মামা আমাকে এক এক করে বুঝান। দয়াবান-এ 'কামিনা' বিনোদ খান্না কিরমন দয়াহীনের মতো মাধুরীর ঠোঁটগুলোকে নিজের সম্পত্তি মনে করেছে এই শুনে আমি নিজেও খান্নাকে সামনে পেলে বিন্নির খই বানানোর পরিকল্পনা করি মনে মনে। সয়লাব-এ হামকো আজকাল হ্যায় ইন্তেজার গানে নোলক পরা মাধুরীর প্রতিটা উন্মাদনা জাগানো অঙ্গভঙীর পুংখানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন মতি মামা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি আর ভিজুয়ালাইজ করি। আহা, যদি একটাবার জ্যাকি শ্রফ, আদিত্য পাঞ্চেলী বা অনিল কাপুর হতে পারতাম কিংবা নিদেনপক্ষে মকবুল ফিদাই যদি হতাম! তাহলেও তো গজগামিনী নিয়ে গুমগুম রবে মেঘ হয়ে ঝরে পড়তে পারতাম সমগ্র মাধুরীতে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে।

মামাকে হঠাৎ চুপ করতে দেখে ব্রোস্ট রেখে কোলায় মুখ রাখি আমি। মামার দৃষ্টি ফলো করতেই দেখতে পাই রোদচশমা পরিহিতা কোন এক বিংশা কিংবা একবিংশা তরুনীকে। 'হুমম, উইম্পিতে তাইলে এই জিনিষও আসে'! মামার সোৎসাহো জিজ্ঞাসা। আমি কিছু বলার আগেই মামা আবার শুরু করে, 'মালডা দেখতে একেবারে মাধুরীর ক্লোন রে। কোমরটা একদম হুবহু।'উৎসাহের আতিশয্যে মামা তরুনীর অন্যান্য অঙ্গ নিয়েও এমন সব মন্তব্য করেন যা শুনলে যে কেউ তার সম্পর্কে বাজে একটা ধারনা করে বসবে। আমি মতি মামাকে চিনি বলেই বুঝতে পারি, একটা তুলনায়ও তার খারাপ কোন ইঙ্গিত ছিলো না। বহুকাল পরে নিজের স্বপ্নের সাথে বাস্তবের মিলে যাওয়ায় বোধকরি এই আতিশয্য।

উইম্পির সেই ঘটনার পর থেকে মতি মামা কেমন জানি বদলে গেলেন। চলাফেরা, চলন-বলন সবকিছুতেই। কয়েকদিন আমাকে ফাও ফাও উইম্পিতে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেনও। এদিক ওদিক চাওয়া চাওয়ি করলেন। মাধুরীকে নিয়ে আমার জ্ঞানসম্ভার বর্ধিত করলেন। এভাবেই চলে গেলো দিনগুলো। মামার বান্ধবীদের সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পেয়ে একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে গেলো এক সময়।

এর পরের ঘটনায় যাবার জন্য আমরা ফাস্ট ফরোয়ার্ড করবো এখন। এবারের ঘটনা কয়েক বছর পরের।

মতি মামার বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। বড় মামা তার কলিগের মাধ্যমে দারুণ এক পাত্রীর সন্ধান পেলেন। মেয়ে ডাক্তার, দেখতে শুনতেও চমৎকার। সিলেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে স্কয়ার হাসপাতালে চাকরি করছে। মেয়ের পরিবার পাত্র হিসেবে চায় ইঞ্জিনিয়ার, যার মানে মতি মামা একেবারে মোস্ট এপ্রোপ্রিয়েট ব্যাচেলর। পরিবার টু পরিবার কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো। কয়েকদফা দেখাদেখিও শেষ। উভয়পক্ষের ই উভয়পক্ষকে পছন্দ। এখন বাকি ছেলে ও মেয়ে উভয়ের কথা সাক্ষাৎ।

ভেন্যু ঠিক করা হলো, উইম্পি, গুলশান। পাত্রের সঙ্গে থাকবে তার ভাগিনা, পাত্রীর সঙ্গে তার মেজো বোন। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা হাজির। মামা ঘামছেন দরদর করে। 'ঐ মর্কট, আমার পাশে পাশেই থাকিস। দেখিস আমাকে একা ফেলে যাসনে যেনো!'আমি হাসিতে আশ্বস্ত করি। 'তোমার তো কূল হলো মামা, এবার তো নিজের জন্যও ভাবতে হয় আমার। জীবনটাতো গেলো তোমার পেছনেই।'

'হতোভাগা শাখামৃগটা বলে কি! আরে, বলি আমি না তোর মামা। লজ্জা করে না মামার মুখে মুখে ফালতু সব কথা বলতে। পাঁজি কোথাকার।'

কি একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। ওরা এসে গেছে। মেয়ের মেজো বোন এলেন, নিজের পরিচয় দিলেন। মামা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন, আমিও। মেজো বোন বসলেন, বসলেন লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখা মামাও। তাদের ফলো করলাম আমি। কিন্তু পাত্রী বসছে না। দেখার জন্য আমি মুখ তুলে তাকালাম এবং তারপর হিম হয়ে গেলাম। আমার হবু মামীর মুখ লাল। লাজে রাঙা হয় নববধূর মুখ। কিন্তু এ রাঙা লাজের নয়, ক্ষোভের। পরের ঘটনাগুলো ঘটে গেলো বিদ্যুৎগতিতে। আশে পাশের টেবিলে যারা বসেছিলেন তারা পরিষ্কার না শুনতে পেলেও মোটামুটি শিওর হলেন ঘাপলা একটা হয়েছে। তারা চলে যাবার পর বিধ্বস্ত মামাকে শুধু বললাম, 'সেদিন ওরকম আপত্তিজনক কথা গুলো না করলেও পারতে মামা। তাহলে অন্তত আমাকে কেউ 'লম্পট'এর ভাগ্নে বলতো না'। মামার কোন উত্তর আমার কানে এলো না, অস্পষ্ট করে যা শুনলাম তা একটি দীর্ঘশ্বাস।

উইম্পি ঘটনার দু'মাসের মাথায় মামা সেই যে দেশ ছাড়লেন তো ছাড়লেনই, আজোবধি আর ফেরেন নি।

সর্বশেষ আপডেটঃ

* মামার সংসার হয়েছে। আমার বিদেশিনী মামী খুব মায়াবি। এক সন্তানের গর্বিত পিতা এখন মতি মামা।
* আমার বিয়ের কথা-বার্তা চলছে। আমরা একে অপরকে অনেকদিন ধরেই চিনি। ও দেখতে হুবহু মাধুরীর ক্লোন। পেশায় ডাক্তার!

***************************************
লেখাটি হাজারদুয়ারীর বিজয়, বর্ষ- বিদায় এবং বরণ সংখ্যার দখিনা দুয়ারে প্রকাশিত।
***************************************

Wednesday, January 02, 2008

ফিরে আসা ক্ষণ, ফেলে আসা স্মৃতি

কাল রাতেই টিভিতে দেখলাম সিডনীতে প্রতিবারের মতো এবারো জমকালো আতশবাজীর কারুকাজে ডার্লিংহারবারের আশপাশের পুরো এলাকা ঝলমলে রাঙিয়ে বরণ করে নেয়া হচ্ছে নতুন বছর। হার্বার ব্রীজ বা অপেরা হাউস দেখলেই ভেতর থেকে চুপসানো বেলুনের মতো একটা বাতাস বের হয়ে যায় হুশ করে। সেলুলয়েডের ফ্রেমের মতো একে একে ভেসে যায় অনেকগুলো ছবি চোখের সামনে দিয়ে। তাদেরই কয়েকটায় দূর থেকে তর্জনীর স্পর্শ বুলাই, দেখি কোথাও ময়লা টয়লা পড়লো কিনা!

সিডনী ছাড়ার আগের থার্টিফার্স্টের ফায়ারওয়ার্ক্সটা দেখেছিলাম একেবারে ব্রীজের গোড়া ওয়ালশ বে থেকে। হোটেলের ফ্রন্টে যারা কাজ করতাম তারা সবাই বেরিয়ে এসেছিলাম সামনের রাস্তায়। মাইক, ম্যাট, ডুয়েন, অ্যান্থনী, ডা(ই)ভিড, স্যালী, স্যাম, এরিখ- আমরা সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ব্রীজ হতে আতশবাজীর বৃষ্টির আকারে ঝরে পড়া। হঠাৎ কে এক মাতালকে আমার খুব কাছে এসে ডার্লিং টার্লিং সম্বোধনে এঁকে বেঁকে, হেলে দুলে কথা বলতে দেখে ভয় পেয়ে 'ওমাগো' চিৎকার দিয়ে সোজা লবিতে চলে গিয়েছিলাম। ফ্রন্ট ম্যানেজার ম্যাক আর ট্রেভর আমার ভয়ার্ত চিৎকারে এগিয়ে এসে সান্ত্বনা দিয়েছিলো, 'ওরা কখনোই তোমার গায়ে হাত দিবে না যতোক্ষণ না তুমি এলাউ করো।' স্বস্তি পেয়ে সিকিউরিটি এল্যানের কাছাকাছি থেকে বাকি সময়টা উপভোগ করেছি। আর মনে মনে বলেছি, 'আমারে ডার্লিং বললি তো বললি তো তুই নিজে সুন্দরী ললনাই হইতি!

দেশে থাকা কালীন বছরের শেষ দিনটায় ঘরে ফিরতে একটু কষ্টই হতো। পুরো কামাল আতাতুর্ক এ্যাভেনিউ হেঁটে আসতে হতো বাস বা অন্য কোন যানবাহনের খোঁজে। সিডনীর বছর শেষের ঝাঝালো আলোতে ধাঁধানো চোখে গুলশান বনানীর অন্ধকারটা বড্ড জ্বালা ধরাতো। কোন রকমে পাশটাশ কাটিয়ে চলে আসতাম সারাদিন খাঁটা, অবসন্ন দেহ নিয়ে।

জার্মানীতে বছর শেষের উদযাপনটাও কেমন নিরামিষ লাগে। না উন্মুক্ত জায়গায় বিরামহীনভাবে চলে পটকাবাজী, না পুটুশ করে খুলে ফেলা শ্যাম্পেইনের বোতল থেকে 'গোলাপজল' ছিঁটানো হয়! কোলনে রাইনের পাড় ধরে ঘন্টাখানেক সময়ব্যাপী চলেছে ছোটখাটো পটকা আর আতশবাজী পুড়ানো। আমাদের দেশে বিয়েতেই এর চাইতে বড় বড় বাজি পুড়ানো হয়। কোলনারেনায় স্বল্প বসনা, শ্যাম্পেইন হাতের লাল রঙা ঠোঁটের সেই ললনা, কিংবা হয়মার্কটে পায়ে এসে রকেটের হামলাকে বাদ দিলে ২০০৭ এর শেষের সময়টুকু মোটেও পার্থক্য আনতে পারেনি অন্যান্য বারের চেয়ে। জার্মানীতে প্রথমবার 'বছর শেষ উদযাপনে' টুকুশ টাকুশ বাজি ফাটানোর শব্দে বিরক্ত হয়ে ঢুকে পড়েছিলাম এক পোলিশ পাবে। ওখানেই পরিচয় হয় পাতার মতো এক পোলিশ মেয়ের সঙ্গে। ওর ভাঙা ইংরেজী আর আমার না-পারা জার্মানে বেশ ভালোই বাৎচিত চালিয়ে গেছিলাম সেরাতে। গল্প শেষে ও চলে গেলো তার পথে, আমি বসে আরেকটা 'রাডলা' মেরে দিলাম নিঃশ্চিন্তে।

বয়স বেড়ে যাচ্ছে নির্ঘাৎ। ৩১ ডিসেম্বরতো তাই জানান দেয়। বুড়িয়ে যাওয়ায় নিজের মনের যে ব্যাথাটুকু, সেটা আড়াল করতেই কিনা মানুষ নেমে পড়ে ঘটিবাটি নিয়ে। পটকা পাটকি আর পানীয়-র পোটলা পুটলী নিয়ে। আর আমি বুড়া হওয়ার জলজ্যান্ত সন্ধিক্ষণে বরাবরের মতো ভাবনার সেলুলয়েডে নিজেকে দেখে ভাবি, 'গল্পটাতো অন্যভাবেও লেখা হতে পারতো!'