Friday, June 29, 2007

নস্টালজিক ভাবনায় নস্টালজিয়া

থ্রী-তে থাকতে এক বিকেলের কথা। তখন বন্দর উপজেলা কমপ্লেক্সের সব পোলাপাইন ইউএনও'র বাসার পাশে বিকেল হলেই ভিড় করে। আমার সমবয়সী বলতে ছিলাম আমরা মাত্র দু'জন। শিমু আর আমি। এক বছর পরের আছে শরীফ, শিমুর ছোট ভাই রতন। বড়রা তখন ভাইয়াদের সাথের। ওদের গ্রুপটা বিশাল। আলমচাঁন হাইস্কুলে যায় সবাই। তো আমরা খেলতে গেলে প্রায়ই যুঁথী আপা আমাদের ধরে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতো, "আচ্ছা এরা কি দুধ খেয়ে ভাত খায়, নাকি ভাত খেয়ে দুধ"?

অনেকগুলো দিন কথাটার মানেই ধরতে পারি নি। কারণ, বাকী বড়রা যে উত্তরই দিতেন, আমরা খেলায় জায়গা পেতাম। কিন্তু স্ট্যাটাসে খানিক হেরফের হতো। আন্ডাবাচ্চা আমরা সেদিকে মনই দিতাম না। এক হাতে হাফপ্যান্ট টেনে ধরে আরেক হাত নেড়ে নেড়ে দৌড়াতাম সারা মাঠময়। গলা ছেড়ে চিৎকার করতাম শুধু শুধুই।

ফাইভে ওঠার পর শ্যামলরা এলো আমাদের বাসার ওপরের তলায়। আমার ক্লাসের শ্যামল আর তার ছোট বোন হাসিনা। জুয়েল ভাই, যুঁথী আপারা ততদিনে চলে গেছেন অন্য জায়গায়। কাজেই আমাদের কঁচিকাঁচা গ্রুপের ততদিনে খেলায় প্রমোশন হয়েছে। এখন আর সেই কোড কথা শুনতে হয় না, ডাইরেক্ট খেলাতে নিয়ে নেয়। কিন্তু তখনো কেনো যেন বুঝে উঠতে পারিনি সেই কথার আড়ালে কী ছিলো!

---------

ছোট মামার বিয়ে হয় সেসময়ই কোন এক বছর। সব কিছু মনে নেই শুধু বিয়ের দিনের একটা কথা মনে আছে। গেটে অনেক ঝামেলা হচ্ছিলো। হয় না, টাকা পয়সা নিয়ে? ঐরকম। আমিতো আর জানি না, আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বরবেশী ছোটমামাকে দেখি নদীর ঢেউয়ের মতো ভীড়ের তালে একবার এদিকে দোলেন আবার ওদিকে। ছোট মামার বন্ধু শহিদুল মামা সেদিন তাঁর বিশাল বপু দিয়ে নাদুসনুদুস দোস্তকে রক্ষা করেছিলেন। সেই থেকে শহিদুল মামা আমার চোখে হিরো! বিয়ের পরদিন সকালে ছোট মামার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বলেছিলাম, আর কখনো ঐ বাড়িতে গেলে শহিদুল মামাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন, তাহলে ওরা আর আপনাকে ওরকম করে এদিক-ওদিক দোলাতে পারবে না। সেদিন আমার ভয়ার্ত কথা শুনে ছোট মামা সশব্দে হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন আর সবাইকে আমার কথা হুবহু বলেছিলেন। বাকীরাও হেসেছিলো, আমি বোকা হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবি, "এমন সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে কেউ হাসে"?

Thursday, June 28, 2007

না চাহিলে যারে পাওয়া যায়

আমি তোমার দূরে থাকি, কাছে আসবো বলেআমি তোমার কাছে আসিনা, চলে যেতে হবে বলেতোমাকে ভালোবাসিনা, তোমাকে হারাবার ভয়ে...

একটা সময় খুব ভাবতাম 'আধো বালি, আধো পানি'র একটা স্বপ্নের কথা। কী করে যেনো সেই স্বপ্নচিন্তাটা ভুলে বসে আছি। এখন আর ওসব চিন্তা ভাবায় না আমায়। একটু ভুল বললাম কি? হুম, হবে হয়তো। আসলে বলা উচিত, এখন অবশ্য ভাবতে ভালো লাগে না। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, অঘটনকে না, বরং যা ঘটেছে কিংবা যা ঘটতে পারতো!

সবুজ প্যাকেটে মোড়া নীল-আকাশ! একটা একটা করে মায়ার সূতোয় বোনা বিশাল আকাশটায় আমার স্পর্শ দিয়ে খুব ছোট্ট একটা প্যাকেটে পুরে দেয়া কি দু:সাধ্য ছিলো কখনোই! আচ্ছা ওইযে ভেজা সিঁড়িটা। ঝুম বৃষ্টিতে চোখের পাতা মুদলেই যে ছাঁট এসে লাগে, ওখানটার কথা বলি? আমার যখন একুশ হলো, তখনকার 'হঠাত হারিয়ে যাওয়ার' কথা। চোখের সামনে দৃশ্যপটের ধীরগতিতে বদলে যাওয়ার কথাও বলা যায়। আচ্ছা হাউ এবাউট, সকালে উঠেই চলে গিয়েছিলাম যে, সেই গল্প!

আমার পেটে তো কথা পঁচে না। কিন্তু মেমোরী এতো বিট্রে করছে কেন? আলোক বর্ষ দূরত্বের তারাদের একে একে সরে যাবার আগের সব কিছুই নিকষ অন্ধকারে। উমমম, হ্যাঁ, আচ্ছা সেই যে রাতের বেলায় ল্যাপটপ ছেড়ে না চাহিলে যারে পাওয়া যায় শোনা, একেকটা ইচিঠিতে চাঁদের আগমন ঘটতো গগনে। একেকটা জুনের জন্য কেমন কেমন করে যেন প্রতীক্ষায় থাকা- যদিবা এই জুনই সেই জুন হয়! কিংবা সাবওয়েতে স্যান্ডউইচ সাপ্লাইয়ে শশ্রুমন্ডিত কোন সাধুর উপস্থিতি শেষে বাসায় ফিরে 'ধপাস'। নিজের বিছানা ছেড়ে যাবার কষ্টে অঝোর কান্না। উঁহু, সেইসব ও বলতে ইচ্ছে করছে না।
ঐযে একবার কাছে আসার খুব আগ্রহ হলো। বিশাল জলরাশি পাড় হবার সাহস ধরে গেলো। শেষে আর হলোই না, আচ্ছা সেই পাগলামীটা বাস্তব হলে কি হতো!কোথাও বেড়াতে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলার সেই যে ক্ষণটা, ওটা নিয়ে বলি বরং! মাউথঅর্গানটার সুর কানের ভেতর দিয়ে গিয়ে মস্তিষ্কে হাতুড়ি পেটা করেছিল যে, কানের সামনে সেই বেসুরো করে ফুঁ দেয়ার ঘটনাটা বলি!

কতো কিছুই বলতে ইচ্ছে হয়, লিখতে ইচ্ছে করে। তবু লেখা হয় না, শোনা হয় না, হিসাব করা হয় না এখন আর। কতদূর এলাম, কতদূর যাবার বাকি- এই ভাবনা আর ভাবতে হয় না এখন। মেইজটা বুঝি শাফলড হয়েই গেলো তবে! পৃথিবীটা ছোট হতে হতেও ক্রমশ: প্রসারিত হওয়া শুরু করলো গ্যালাক্সির অনুপাতে। অনেক হিসাব, অনেক নিকাশ সেখানে লুকায়িত। এখানে তাত্ত্বিক ভাবে অনেক ভ্যালু উপেক্ষা করা গেলেও ফলায়তভাবে করা গেলো না।

ফিরতে বড় ইচ্ছে করে, ফেরারী সেই পথটি ধরে-কিন্তু লক্ষ্য বিন্দু বুঝি কক্ষচ্যুত। শত বারণের চোখ রাঙানী শেষেও কথা বলা থেমে থাকে না, ভাবনা থেমে থাকে না, দিন গুলোর কথা ভুলে যাওয়া হয় না, দেখার ইচ্ছাটা উবে চলে যায় না!

নিজের অজান্তেই হিসাব মেলানো হয়ে যায় ২৩ + ৬ - ১৭ = ১২

ছ'বছর আগের চমতকার করে শুরু হওয়া একটা দিনের মতো সেই ভাবনা গুলো আজোবধি জেগে আছে, কেবল ওপরে একটা ধূলোর ডিবি জমে গেছে। সেই ডিবির ওপরে লালসালু উড়ছে, বিপদের আভাস দিতে না বরং জানান দিতে যে জায়গাটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ!

কতো কিছুই বলার ছিলো, থাকুক নাহয় সব তোলা-আজ শুধু বলি - শুভ হোক এই পথচলা...

Wednesday, June 20, 2007

ড্রীমল্যান্ড ও ড্রীমগার্ল

বিছানায় শুয়ে শুয়ে বেরানোর ধারণাটা আগুন। গলার পরে কয়েক পেগ তরল ঢেলে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেই মন চলে যায় রূপের নগরে! সেখানে একটা ঘোড়ার গাড়ি সাজানো থাকে গাড়োয়ানহীন। উঠে বসলেই ঘোড়া চলতে শুরু করে। ইটসুড়কীর বাঁধানো পথ পেরিয়ে, ঘন ঝোপের পাশ কাটিয়ে গাড়িটি হঠাৎ বাঁক নেয় অজানা এক মেঠোপথের দিকে। মেঠোধূলার পথ, কিন্তু কি আশ্চর্য, কোন ধূলা উড়ে না! গাড়োয়ানহীন গাড়িটি এগিয়ে যায়। টিমটিমে আলোর লোকালয় পড়ে থাকে পিছনে। হলুদ সরষে ক্ষেতের বুকচিরে গাড়ির চাকা গড়িয়ে চলে এক গহীণ বনের দিকে। আকাশ উপচে পড়া জোৎস্নার আলোয় এক নীলাভ ছায়া অবলোকিত হয়। অরণ্যের ওপারেই আছে স্বপ্নের সেই ভূমি যেখানে নীলাম্বরী এক চুল খোলা ললনা দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁয়। চিঁহিহিহি শব্দ তুলে ঘোড়াগুলো এগিয়ে যেতে থাকে...

Sunday, June 17, 2007

বাবা দিবসের আখ্যান

এদেশের লেবার রুমে যাবার নিয়ম কানুনে বেশ কড়াকড়ি। নিয়মকানুন ব্যাপারটাই আমার অসহনীয় লাগে। আর আমার 'লেইট' হওয়াটা কখনোই কাটাতে পারিনি, আজ এতোগুলো বছর পরেও।

প্রাণের সহধর্মীনি স্ট্রেচারে শুয়ে আছে লেবার রুমে, তাকে কথা দিয়েছি আমি তার সাথে থাকবো, কিন্তু এখনো আমাকে নানা রকম কাগজপত্রে সই করে যেতে হচ্ছে। ওদিকে আমার আদরের বউ বলে দিয়েছে আমার হাতে হাত রাখা ছাড়া এনাস্থেশিয়া নেবে না। ডাক্তাররা যতোই বুঝাচ্ছে এতে করে জটিলতা বাড়তে পারে, কিন্তু বউ নাছোড় বান্দা হয়ে গোঁ ধরে রয়েছে।

একজন নার্স এসে আমাকে যখন জানালো এ কথা। আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো সতেরো বছরের সেই অবোধ বালিকার কথা। একগুঁয়ে আর কাকে বলে। সেই প্রথম দিন থেকেই তার একগুয়েমীটাকে আমার ভালো লেগে এসেছে। আশ্চর্য! কোনদিক দিয়ে দিন কেটে যায়। সেদিনের ১৭ বছরের বালিকা, যে চটাং চটাং কথা বলতো আমাকে, সে আজকে আমার মেয়ের মা হবে!

একগাদা কাগজ সই করার পর ডাক্তারের সাথে ঢুকলাম লেবার রুমে। আমাকে দেখেই সে যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। "তুমি একটা এম্পটি হেড। এতো দেরী করলে কেন, কষ্ট তো হচ্ছে আমার, তুমি বুঝবাটা কি..." ডাক্তার নার্সরা এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ী করে। আমি আস্তে করে গিয়ে ওর বাম হাতটা আমার ডান হাতে নিলাম, কপাল থেকে রেশমী চুলের জঙলা সরিয়ে আলতো করে চুমো খেয়ে বললাম, "বধূ আমি আছি তোমার পাশে। আমাদের স্বপ্ন আজ জন্ম নিবে। জন্ম হবে একটা নতুন উচ্ছ্বাসের, এই উচ্ছ্বাস তোমার আমার। আমাদের 'তনয়া'...।"

ও আতংকিত চোখ করে বললো, "আমার ভয় করছে। আমি যদি না বাঁচি আর..."
বললাম, "ভয় পেয়োনা জান। ভেবে দেখতো কতোগুলো দিন আমরা এই স্বপ্নের জাল বুনে গেছি। কতগুলো বৃস্টিস্নাত রাত কাটিয়েছি আমরা খোলা আকাশের নিচে, সেই সিঁড়িতে বসে তোমার বাম হাত আমার ডান হাতে ধরা...। আমি আছি তোমার সাথে, ভয় নেই একটুও!

নার্সের হাতের মাস্ক ওর নাক-মুখ আড়াল করে দিতেই যেন গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো। আমার ভেতরটা কেমন যেন খচ করে উঠলো, সয়ে নিলাম।

তনয়ার জন্ম হলো। আমার তনয়া, আমাদের তনয়া, আমাদের দুজনের মিলিত স্বপ্ন। আজকে আমার, আমাদের তনয়ার ৬ বছর পূর্ণ হলো বধূ, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো! তুমি কি দেখতে পাচ্ছো আমাদের স্বপ্নের বেড়ে ওঠা, আমার বাবা হওয়ার গম্ভীরতা!

Sunday, June 10, 2007

আজগুবি স্বপ্নের দু:স্বপ্নে ভ্রমন

আজকে পিকুলিয়ার একটা স্বপ্ন দেখলাম। একটু ভয়ও লাগছিলো। শিবিরের সাথে এনকাউন্টার হইছে, সরাসরি। ঘটনাটা এরকম।

বনের সিটিহলের সামনের স্টেজে বাংলাদেশের হর্তাকর্তারা বসে আছে। সাথে দেখলাম জামাতী অনেক হোমরা চোমরাও সেখানে আছে। তো সেখানে বাংলাদেশের দেশাত্ববোধক গান হইতাছে। কি একটা গান, তার মধ্যে জয় বাংলা, বাংলার জয় কথাটাও আছে। আমি স্টেজের বাম কোণায় বসা। এদিক থেকে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা হইতাছে।

গানটার মাঝে যখনই 'জয় বাংলা' শব্দটা আসে, সবাই কেমন মিন মিন করে গায়। আমি কি মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে মাইকের সামনে গিয়ে বেশ জোরেই কয়েকবার 'জয় বাংলা' কথাটা উচ্চারণ করলাম। সাথে সাথেই কয়েকজন এসে আমাকে নামিয়ে নিয়ে গেলো স্টেজ থেকে। এদের মধ্যে শিবির সভাপতিও ছিলো।

কোন একটা গলির মুখে আমারে নেয়ার পথে দেখলাম ব্লগের পরিচিত কয়েকজন সহ আরও কিছু লোকজন তাগোরে এটাক করছে। আমারে ছাইরা দিয়া তখন ওরা পজিশন নিছে 'মোল্লা মার্কেটের' এদিকে।

আমাদের এদিকে কলাপসিবল গেট আটকানো, ওরা গুলি করতাছে সেই গুলি গেটে লইগা ছিড়্ড়ুম ছিড়্ড়ুম আওয়াজ হইতাছে। এর মধ্যে খেয়াল করলাম আমার ছোট ভাইডারে পাইতাছি না। ও একদম পিচ্চি, ওরে জামাইত্যারা গুম কইরা দিছে। আমি সমানে খুঁজতাছি।

পুলিশ আইলো, আমাদের পিছন দিয়া আইসা গেট খুইলা ওগোরে চেক করলো। একটা পোলা, যে নাকি শিবিরের সভাপতি হইতাছিলো তার কোমর থাইক্যা উন্নত মানের এক অস্ত্র পাওয়া গেলো। যেইটারে ও নাম দিলো কি এক জাতের ব্লেড কইয়া। আমি তখন চরম অস্থিরতার মাঝে। ছোট ভাইডারে পাইতাছিনা, ভিতরে খুব খালি খালি লাগতাছে। কান্দোন আইতাছে সমানে...

ঠিক এই মুহূর্তেই ফোনটা টুট কইরা বাজলো, উইঠা গেলাম।
ভয়েড অনুভূতিটা এখনো, অলমোস্ট ৯ ঘন্টা পরেও যায় নাই। ঘুম কম হইছে বইলা চোখ ফুইলা আছে রুই মাছের চোখের লাহান।

স্বপ্নটা কেন দেখলাম বুঝতাম পারতাছিনা...!

Sunday, June 03, 2007

কোন এক হিরোর কথা

উপসাগরীয় যুদ্ধের অব্যবহিত পরের কথা। মধ্যপ্রাচ্য তখন সরগরম আমেরিকা-ইরাক ইস্যুতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত কুয়েতের পূনর্গঠন প্রয়োজন। এর জন্য চাই প্রচুর শ্রমিক। প্রচুর বিদেশী শ্রমিক, অভাব অনটনে থাকা তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিক যাদের অল্প পারিশ্রমিকে কাজ করানো যাবে। যারা তাদের সামর্থ্যের সেরাটা দিবে, এমন শ্রমিক চাই। সবদিক বিবেচনা করে উপমহাদেশের জোয়ান তরুণদের চাহিদা তুঙ্গে তখন মধ্যপ্রাচ্যে। জনশক্তি রপ্তানীর এজেন্টদের তখন রমরমা অবস্থা। লোকজন আসে, ইন্টারভিউ দেয়, মেডিক্যাল টেস্ট করায়, টাকা দিয়ে বাড়ি চলে যায়। "ভিসা লাগলে খবর দিমু নে"- এরকম কথার ওপর বিশ্বাস নিয়ে বাড়ি চলে আসে মধ্যপ্রাচ্য গমনে প্রত্যাশী তরুণ।

শফিকুল, চরম হতাশাগ্রস্ত একজন গ্রাম্য তরুণ। তেমন কিছুই করে না। তারা চার ভাই, দুইবোনের একজনের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বাবার বেশ কয়েক বিঘা কৃষি জমি আছে। মোটামুটি চলে যায় সারাবছর কৃষিকাজ করে। উপসাগরীয় যুদ্ধের পরে কুয়েত পুনর্ঠনে যোগ দিতে সচেষ্ট হয় সে। এজেন্টের কাছে টাকা দেবার অভিপ্রায়ে বেঁচে দেয়া হয় তাদের কয়েক বিঘা জমির অনেকটা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, এজেন্টের কাছ থেকে "কালকেই ফ্লাইট" টাইপের একাধিকবার নাকানী-চুবানী খেয়ে যখন সে ম্রিয়মান ঠিক তখনই একদিন খবর আসে তার "ভিসা লেগেছে", কাল ভোরে ফ্লাইট, এক্ষুনী যেতে হবে।

গাঁয়ের সবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায় শফিকুল। পিছনে তার মা বড় রাস্তাটা পর্যন্ত আসেন আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে। ছেলে বিদেশ চলে যাচ্ছে কতগুলো বছরের জন্য কে জানে, এই ভাবনা তাঁকে কুঁড়ে খেলেও শফিকুলের বাবা ভাবেন তখন অন্যকথা। জমি বেঁচে দেয়া টাকা, যদি কোন রকমে ফসকে যায় তাহলে সংসারের কী হবে!

মায়ের চোখের পানি, বাবার উদ্বিগ্ন চোখ, ভাইদের আশান্বিত দৃষ্টি সাথে করে শফিকুল অবশেষে কুয়েতগামী বিমানে চড়ে বসে। হ্যাঙ্গার থেকে বের হয়ে বিমান ট্যাক্সিং করছে এখন, শফিকুল জানালা গলে বাইরে তাকিয়ে আছে। কী সুন্দর ঝলমলে রোদ! আচ্ছা, ও যেখানে যাচ্ছে সেখানে কি এরকম সুন্দর, মনোরম, ঝলমলে রোদ উঠে? সেখানেও কি বিকেল বেলা দক্ষিণ দিক থেকে আসা বাতাসে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া যায়? সেখানেও কি গোধূলী বেলাতে গোয়ালে গরু আনার তাড়া পরে যায়? সন্ধ্যা বেলায় কি সেখানেও কাটা ধান কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরে লোকজন, কারেন্ট চলে গেলে কি সেখাও বাড়ির সবাই উঠানে ওগলা পেতে বসে গল্পো করে? সেখানকার মানুষেরা কি অনেকদূরের গ্রামের কোন মানুষকে বিনা পরিচয়েই ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে প্রজন্ড গরম থেকে বাঁচতে একটা বাতাসার সাথে এক গ্লস পানি দেয়?
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে শফিকুল। বিমান ততক্ষণে ট্যাক্সিং থেকে রানওয়েতে, টেকঅফ করার মুহূর্ত! জানালার কাঁচে হাত রেখে শফিকুল কেঁদে চলে অনবরত। হাতের স্পর্শে সে যেন বাইরের আলো, বাইরের বাতাস, বাইরের প্রকৃতিকে ছুঁতে চাচ্ছে কিংবা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে যেমনটা মানুষ করে অতিপ্রিয় কোন জিনিষকে ছেড়ে যাবার সময়!

সময় চলে যায় নিজস্ব গতিতে। বাড়ি থেকে চিঠি আসে, চিঠি যায়। শফিকুল প্রতি চিঠিতেই জানতে চায় তার লাগানো জাম্বুরা গাছে জাম্বুরা ধরেছে কিনা, পুকুরের পাশের ডোবা এবর সেঁচা হলো কিনা, ইরির ফলন কেমন হলো এবার, পাশের বাড়ির রমুকাকা ছেলেপেলে নিয়ে এখনো কষ্ট করে কীনা, নিজের দাদী নেই, চাচাতো দাদীর বয়স হয়েছে যত্ন-আত্নির যেন কমতি নাহয় তার। এভাবেই সে চিঠি লিখে প্রতিবার, চিঠির সাথে পাঠিয়ে দেয় তার কষ্টের বেতনের থেকে বাঁচানো সিংহভাগের ব্যাংকড্রাফট!

শফিকুলদের বাড়িতে পাওয়ারলুম হয়েছে। সেখানে তার ভাইয়েরা কাজ করে। তাঁত বুনে, প্রতি মঙ্গলবারে সেই তাঁত তারা হাঁটে নিয়ে যায়, বেঁচে। বেড়ার ঘরের বদলে এখন ভিটপাকা চৌচালা হেছে শফিকুলদের। বড়ভাই বিয়ে করেছেন বছর খানেক হয়, বোনটার জন্য ভালো জায়গা থেকে সম্মন্ধ আসছে। মা চোখে দেখতেন না, ডাক্তার দেখিয়ে এখন চশমা নিয়েছেন। বাবাকে ভাইয়েরা রিটয়ারমেন্টে দিয়ে দিয়েছে "এখন আপনে আল্লা বিল্লা করেন" - এই বলে। সবই সুন্দর চলছে, সবকিছুই ঠিক। নিজের অজান্তেই শফিকুল একজন হিরো। তার পরিবারের সবার কাছে, তার চাচাতো দাদীর কাছে, তার রমুকাকার কাছে।

কিন্তু শফিকুল? সবাইকে ছেড়ে একা পড়ে আছে সুদূর মরুভূমিতে। হয়তো সে কাঠাফাটা রোদ্দুরে, দুপুরের কোন এক সময়ে হাড়ভাঙা খাটুনির ফাঁকে একটু বসে কোন জায়গায়। মাথা থেকে ময়লা লাগানো ক্যাপটা সরিয়ে ঘর্মাক্ত মুখটা ডানহাতের তালু দিয়ে মুছে উদাস দৃষ্টিতে ভাবে দেশে থাকার সেই দিনগুলোর কথা। নিজের গ্রামের কথা, সরষে ক্ষেতের আইল ধরে দৌড়ানোর কথা, বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলার কথা, মায়ের হাতের শোল মাছ দিয়ে গাছের প্রথম লাউয়ের ঝোল খাওয়ার কথা।
এসব ভাবতে ভাবতেই হয়তো একসময় ডাক পরে শফিকুলের, কাজে ফেরত যাবার ডাক!

অনিচ্ছা সত্বেও ময়লা ক্যাপটা মাথায় চাপায় শফিকুল। প্যান্ট গুটানো পা আবার শক্ত হয়ে ওঠে, না তার বিলম্ব করা উচিৎ হবে না একেবারেই। হিরোদের বিলম্ব করা মানায় না, হিরোদের থেমে গেলে চলে না। হিরো, আমাদের হিরো শফিকুলেরা!!

-।-।-।-।-।-।-।-।-।-।-।-।-

* একই সাথে হাজারদুয়ারীতে প্রকাশিত।

** যারা 'হাইলী লোস্পীড সিনড্রোমে' ভুগছেন তারা এখানে ট্রাই দিতে পারেন। ইউনিকোডে হাজারদুয়ারী