Sunday, January 27, 2008

ইনহাস্ত ওয়াতানাম

'তোর জন্য আমার মনটা পুড়ে। কলজেটা খা খা করে। বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে বারবার- এইটা বুঝস? তারপরেও বলবি আমি তোরে মনে রাখি নাই! আমার প্রতিটা মুহূর্ত ক্যামনে যায় সেইটা কেবল আমিই জানি। চোখের পানি লুকাতে বুকে যে খরস্রোতা নদীর ভাঙন খেলে এইটা আমি কারে বলি!... ... ...'

আমার মা, দুষ্টামী করে আমাকে ভুলে গেছে কি না জিজ্ঞেস করতেই এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো উগড়ে দিলো দূরালাপনীর ভেসে আসা কম্পনগুলোতে। শেষের দিকে এসে আর স্বাভাবিক রাখতে পারেনি নিজেকে। কাঁপা গলায় ভেজা আওয়াজে ফোশফোশ করছিলো। আমি সন্তর্পণে চোখ মুছি, গলা স্বাভাবিক রেখেই বাৎচিত চালাতে হয়। আমার সামান্যতম দুর্বলতা টের পেলেই ওইদিকে ভেঙে পড়বে শতবছরের পুরনো বাঁধ। তখন হয়তো প্রয়ঙ্করী বাণটাকে আর আটকানো সম্ভব হবেনা কিছুতেই!

একাকীত্বকে আমি সবসময়ই উপভোগ করি। আমি কোনকিছুরই দাস নই। কিন্তু তাও সয়ে গেছে মা-বাপ, ভাইদের ছেড়ে থাকতে থাকতে। শুধু কয়েকটা সময় হুটহাট করে সব তেড়ে আসে প্রবল তোড়ে আমার শীর্ণ দুয়ারে আঘাত করতে থাকে। এমনই একটা সময়, যখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। মাকে খুব মনে পড়তে থাকে তখন। স্কুল কামাইয়ের লোভে যখন ইচ্ছে করে জ্বর বাঁধিয়ে বসতাম মা তখন মাথায় জলপট্টি দিয়ে এক নিঃশ্বাসে বকাঝকা করতো। আমি মিটিমিটি হাসতাম, নানা খাবারের বায়না ধরতাম। মা তখন বিশাল একঝাপি গালি আমার মাথায় ঢেলে দিয়ে পছন্দের সবকিছু বানিয়ে মুখের সামনে তুলে ধরতো। খেতে পারতাম না কিছুই তিতা রসনার কারণে। এই আমি গত একসপ্তায় কিছুই খাইনি। না তেতো স্বাদের জন্য নয়, ঘরে কিছু বানানোর ছিলো না তাও নয়, কিন্তু উঠে রান্নাঘর পর্যন্ত যাওয়া আর সব যোগাড়যন্ত করে উনুনে চড়ানোটা বেশ অতীতের কাজ মনে হচ্ছিলো। বাইরে খাওয়ার রূচি নেই। খাবার দেখলেই বমিচ্ছা হয়। বুকের ভেতর থেকে আস্তে করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে, মা থাকলে নিশ্চই খাওয়ার এই কষ্টটা করতে হতো না। ঠিকই কি মুখে রচবে, এমন কিছু চলে আসতো চোখের সামনে। খেতে হতো জোর করেই!

বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলো। আমার একটাই মাত্র বড় ভাই। তার বিয়েতে যাওয়া হলো না, খুব ছোটবেলা থেকে ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে বুণা স্বপ্নগুলো শেষাবধি আর মালা হতে পারলো না। আমার কষ্টটা আরো বেশী লাগার কারণ মা খুব কেঁদেছে তাঁর মেজো ছেলে না থাকাতে। আমি মাকে কী করে বুঝাই, 'মাগো তোমার ছেলের যে যাযাবর হওয়ার শখে পেয়েছে...'।

ফোনে কথা বলছি, দুষ্টামী করছি, হাসছি- মা হঠাৎ বলে ওঠে 'তুই কি খুশীতেই হাসতেছিস নাকি নিজের কষ্টটা লুকানোর জন্য!' মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে যাই, বাকহারা আমার আর রা' সরে না। প্রসঙ্গ পালটাই, ছোট মামার পিচ্চিটা বড় হয়ে যাচ্ছে। কটকট করে কথা বলে এখন। প্যান্ডা পেয়ে খুব খুশী হয়েছে।

গ্রামেই কেটেছে বেশিরভাগ সময়। গ্রামকেও চিনি তাই অনেক বেশি শহরের তুলনায়। চিনি গ্রামের মানুষগুলোকে। উপলব্ধি করতে পারি গ্রামের গন্ধটাকে। ষড়ঋতুর দেশে বৈচিত্র কমে গেলেও গ্রীষ্মের গন্ধের সঙ্গে যে বর্ষার গন্ধ কোনমতেই খাপ খায়না এটা বুঝতে পারি। শরৎ আর শীতের গন্ধেও তফাৎটা বিশাল। আমি থাউজেন্ডস মাইল দূরে উষ্ণ কক্ষের নরম বিছানায় শুয়েও গন্ধ গুলোকে উপলব্ধি করতে পারি। প্রতিটা ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথেই মাটির রং, রস গন্ধও বদলায়। আমি সেই গন্ধ সারা গায়ে মেখে ইট-পাথরের বাধাই করা পথে দৌঁড়াই। ছোটভাইকে ফোন ধরে বিভিন্ন রাস্তা ধরে হাঁটতে বলি, আমি বলে বলে দেই ও কখন কোন বাঁশঝারের কাছ দিয়ে যাচ্ছে, এই মাত্র রাস্তার কোন মোড়টি বাঁক নিলো সে, আমি এখানে বসে বলে দেই। ভাই অবাক হয় না, এটা যেনো জানারই কথা; কিংবা অবাক হলেও জিনোটাইপের কারণে সেটা প্রকাশ করে না।

আমার খুব ইচ্ছে করে মূলহীন জীবনের ইতি টেনে ফিরে যাই আমার মায়ের কাছে। অনিশ্চয়তার কোলে সঁপে দিই নিজেকে। কী হবে, যেখানে আর বারো কোটি মানুষ বেঁচে আছে সেখানে আমি কি বেঁচে থাকবো না! হোক না ছাপোষা, তাও তো অসুস্থ হয়ে পড়লে কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা মেপে দেখার মতো কেউ থাকবে আশে পাশে। না থাকুক সেখানে রঙীন দামী নোটের কড়কড়ানি, অন্তত ম্যাড়ম্যাড়ে কয়েকটা পুরনো ময়লা পঞ্চাশ টাকার নোট তো হাতে গুজে দিবে কেউ। তাতেই খুশী আমি। আমার আর ভালো লাগে না সৃষ্টিহীন এই দিনাতিপাত, আর ভালো লাগে না অভব্য এই ইঁদুর দৌঁড়। মা-মাটি-মাতৃভূমি, যেমনই হোক- যেমনি থাকি সেই তো আমার জন্মভূমি।

No comments: