Sunday, November 16, 2008

বধুয়া

: ঘুমাচ্ছিস বুঝি...! তোর হাতটা একটু ধরি?
আমার আজন্ম সাধ তোর হাতটা ধরার, তোকে একটু ছুঁয়ে দেয়ার- আলতো করে।

: ক্যান, হাত ধরবি ক্যান!
চোখ বন্ধ রেখেই তুই ঝলমলিয়ে উঠলি। কিন্তু পরক্ষণেই আমার ঘোলা দৃষ্টির কথা ভেবেই কী না তুই মৃদু করে হাসলি। বললি,

: আমি ঘর হইতে বাহির হইয়া জোছনা ধরতে যাই, হাত বাড়াইলেই চান্দের আলো, ধরতে গেলেই নাই...

আমি পুরোপুরি বুঝতে পারলাম তোকে। সম্ভবতঃ এই প্রথমবারের মতো। হাত বাড়িয়ে দিলাম তোকে ছুঁয়ে দেবার জন্য। তোকে স্পর্শ করলাম। বিশ্বাস কর একদম বাস্তব, সত্যি ছোঁয়া। তোর উষ্ণতা আমার হাতের আঙুলে লেগে গেলো। তোর স্পর্শ এখন আমার অস্তিত্বে। কিন্তু আমি জানি তুই এসবের কিছুই অনুভব করিসনি। জোছনার মতোই তোর হাত গলে অনুভবহীন আমার স্পর্শ গড়িয়ে পড়ে গেলো!

: তুই আগে বলতিস। একটা ডোরাকাটা মাছ হয়ে সূর্য্যের আলোয় ঝিলমিল করতে থাকা শান্ত নীলাভ পানিতে সাঁতরে বেড়াতে ইচ্ছে করে খুব তোর। এখন করে না?

: করে তো, এখনো করে। কিন্তু নীল রঙটা কেমন একটু ফ্যাকাশে ঠেকে এখন। আগের সেই উজ্জ্বল আবহটা কেমন যেনো নাই হয়ে গেছে রে। তোরও তো একটা নীলরঙা পাখি হয়ে নীল পাহাড়ে বৃষ্টির পর রঙধনুর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো!

: আমার তো রঙধনুর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা এখনো করে!

আমি জানি আমার পাখি হবার সেই বাসনা কখনো শেষ হয়ে যাবে না, যেমনটা শেষ হয়ে যাবেনা তোর আশেপাশে ঘুরঘুর করার, তোকে একটু ছুঁয়ে দেখার অন্তঃপ্রাণ ইচ্ছেটা। কখনো শেষ হয়ে যাবে না আমার বুকের মধ্যে বৈশাখের ঝড়, তোর জন্য!

: জানিস, আমি সেদিন একটা তাঁতের শাড়ি কিনেছি। কালো জমিনে সোনালী পাড়। খুব সুন্দর। এখনো পরিনি, ভাজ গুলোও খুলিনি।

: শাড়িটায় তোকে খুব সুন্দর লাগবে বুঝতে পারছি। এখন পরবি নাকি! যা পরে আয়, আমি দেখি।

: তুই আসলেই একটা পাগল। এখন পরবো ক্যামনে, আমি ঘুমাচ্ছি না...?

: হ্যাঁ, তাইতো। তুই তো চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছিস!

: আর এখন শাড়িটা পরবোও না। সামনে একটা প্রোগ্রাম আছে। ওখানে শাড়িটা পরবো, ছবি তুলে তোকে দেখাবো...।

: ঠিক আছে, তাই হোক তাহলে।

আমি জানি এটা সম্ভব না। তুইও জানিস। হয়তো বিশ্বাস করছিস না। বিশ্বাস আমিও হয়তো করছি না। থাকুক না আমাদের বিশ্বাসটুকু এই মুহূর্তের জন্য তোলা হয়ে। আমরা ভেবে যাই যেমনটা আমরা ভাবতে চাই। এখন... এই মুহূর্তে... দুজন পাশাপাশি...।

: তোর কালো টিপ আছে না?
: আছে তো।

: কতো বড়ো!
: তোর না প্রশ্নের কোনো মাথামুণ্ডু নাই। টিপের আবার বড়-ছোট-মেঝো কি। আমার কড়ে আঙুলের মুখের সমান হবে!

: নাহ্, অতো বড় না। তোর সঙ্গে এতো বড় টিপ যায় না। তুই পরবি একদম ছোট টিপ। মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় যে সাইজের বৃত্তগুলো ভরাট করতে হয়, ওরকম আকারের টিপ।

: হাহাহা... তুই আবার টিপ বিশেষজ্ঞ হলি কবে?

: এগুলো হলো টেস্ট মাদাম, বিশেষজ্ঞের ব্যাপার না। ও হ্যাঁ, হাতে চুড়ি পরবি ঝিনুকের, সোনালী অবশ্যই। তোর আছে আমি জানি।

: বাহ্ তুই তো দেখি আমার কাবার্ডের ভেতরের জিনিষের ব্যাপারেও ধারণা নিয়ে বসে আছিস।

: হাহাহা... তা তো আছিই! তোর কাবার্ডের কোন ড্রয়ারে কোন জামা রেখেছিস সেটাও জানি আমি। কোন ড্রয়ারে শাড়ি আর কোন ড্রয়ারে অন্তর্বাস আছে বলি...?

: না...! একদম না!! তুই থামবি!!! তোর সব ব্যাপারে মহাজ্ঞানী হওয়ার কোনো দরকার নেই। আপনার সুমর্জি হলে কিছু কিছু ব্যাপার নাহয় আমার উপরেই থাকুক মহারাজ!

আমি তোর রিনিঝিনি হাসি অনুভব করলাম। তুইও কি করলি একইভাবে আমাকে? তোর বাম গালে ছোট্ট টোলটা দেখতে পাচ্ছি আমি। ঈশ, তুই জানিসও না তোর গালের ওই ছোট্ট টোলটা দেখার জন্য আমি শতাধিকবার নশ্বর হতেও রাজী।

: তুই কি আমাকে ভাবিস?
: হুম, ভাবি।

: কী ভাবিস!
: ভাবি, তুই কেনো অমন করে সেদিন আমাকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে গেলি? কী করে পারলি তুই!

: তোকে অনেক ভালোবাসি যে!
: এ কেমন তোর ভালোবাসা...!

: তুই বুঝবিনা।
: বুঝবো, তুই বল।

: শোন, আমার অনিশ্চয়তার সঙ্গে তোকে জড়িয়ে ফেলতে চাইনি। যখন রিপোর্টগুলো হাতে পেলাম আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো যেনো। নিজের শরীরের এতোটা খারাপ অবস্থা, অনেকটা অজান্তেই ছিলো আমার। আমার সামনে তখন দুটো পথ খোলা ছিলো, দামী চিকিৎসায় নিজেকে সমর্পন করে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া অথবা সব পেছনে ফেলে বাকী ক'টা দিন নিজের মতো করে বেঁচে থাকা। আমি দ্বিতীয় পথে হেঁটে গেছি। এই পথে তোর কোনো স্থান নেই যে! এই পথটা কেবলই আমার একার। মায়ার জালে জড়িয়ে গেলে তখন ছেড়ে যেতে অনেক কষ্ট হতো রে, ছেড়ে দিতে তোর ও অনেক কষ্ট হতো!

: (তোর হাসি হাসি মুখটা আর নেই) এখন কি খুব সুখ হচ্ছে বলতো! তুই কি জানিস তোকে আমি কতো খুঁজেছি। সারাটা শহর তন্নতন্ন করে চষে বেরিয়েছি তোর খোঁজে। তুই ছিলি না। তোর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো পথই তুই খোলা রেখে যাসনি। একেকটা দিন আমার কি বিষাদে কেটেছে তুই জানিস না! তোর কষ্টে বুকের ছিঁড়ে যাওয়া একেকটা ধমনী কী করে জোড়া লাগিয়ে এখনো বেঁচে আছি, তুই বুঝিস...!

তোর গালের টোলটা মিলিয়ে গেছে সেই কখন। একি, তোর চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে! তুই কাঁদিস না প্লীজ।
আমার ওখানে অনেক অন্ধকার। তুই জানিস, আমি অন্ধকারে থাকতে পারি না। অস্বস্তি হয়। তোকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হয়। তোর হাসি, গালের টোল দেখতে চলে আসি তাই। তোর চুলের গন্ধ আমাকে বেঁচে থাকার স্বাদ যোগায়। বিশ্বাস কর, তোকে কষ্ট দেয়ার জন্য আসি না। আমি যে তোকে ভালোবাসি, এখনো।
আমি জানি আজ তুই ঘুম থেকে উঠে কতোক্ষণ জানালা দিয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবি। তারপর তৈরী হয়ে তোর নতুন তাঁতের শাড়িটা ভাজ ভেঙে পরবি। কপালে কালো রঙের ছোট্ট টিপ দিবি, হাতে সোনালী ঝিনুকের চুড়িগুলো গছাবি। তারপর কিছু না খেয়েই বেরিয়ে যাবি। শাহবাগ থেকে আমার পছন্দের গোলাপ-গেন্দা-রজনীগন্ধার একটা তোড়া নিবি। একটা সিএনজি ডেকে বলবি, "মহাখালি বাসস্ট্যাণ্ড!" ভাড়া বেশি চাইবে, তুই কিছুই বলবি না, চুপচাপ উঠে বসবি। কিছুক্ষণ পরে তুই টাঙ্গাইলের বাসে চেপে বসবি। তোকে আজ অন্যরকম লাগবে। একদম অপরিচিত কেউ। বাসের জানালা দিয়ে আসা বাতাস তোর চুলগুলো এলোমেলো করে দিবে। তুই কাঁদবি, কিন্তু কেউ তোর কান্না দেখবে না। টাঙ্গাইল নেমে তুই যাবি ভবনটেকি গ্রামে। ওখানে একটা পরিত্যক্ত জায়গায় ক্ষয়ে যাওয়া বাঁশের চাইয়ে ঘেরা একটা কবরের পাশে ফুলের তোড়াটা রেখে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকবি অ-নে-ক-ক্ষ-ণ। গোধূলি বেলায় তুই আবার ফিরে আসবি। ফেরার পথে হয়তো দেখবি কোনো এক নীলরঙা পাখি উড়ে যাচ্ছে কোথাও! সাঁঝের আলতো বাতাসে তুই মুখ বাড়িয়ে বসে থাকবি, আর ভাববি বাতাস হয়ে বুঝি আমি তোর চুলে আদর করে দিয়ে যাচ্ছি। তুই ফিরে যাবি আমাকে অন্ধকারে একা রেখে। আমি জানি, তুই আবার আসবি, আবারো। কারণ তুই যে আমার বধুয়া!

Monday, November 10, 2008

গুরুচন্ডালী - ০১২

গরম জিলাপীঃ

আজকে ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো হঠাৎ। উঠে বসলাম। মাথা একবার ডানে আবার বামে ঘুরিয়ে দেখছি ভ্যাবলাকান্তের মতো। সব কেমন পরিবর্তিত লাগছিলো, আক্ষরিকই। কালকে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে যেমনটা দেখে গিয়েছিলাম তেমন নেই। মনে খটকা লাগলো! বাইরে বেরুলাম। সিঁড়িতে দেখলাম কালো আলখাল্লা পরিহিত এক বুড়ি বসে কাঠবাদাম না কী জানি খাচ্ছে। দেখতে অনেকটা 'উইচ'এর মতো। আমাকে দেখে বাদামের ঠোঙা সরিয়ে বসতে বললো। কিছু একটা বলতে চায় আমাকে। আমি বসি নাই। একটা টেনশন হচ্ছিলো। বুঝতে পারছিলাম, আমি ভবিষ্যতের কোনো একটা সময়ে চলে এসেছি। আমাকে 'বর্তমানে' ফেরত যেতে হবে, সেটা কী করে আমি বুঝতে পারছিলাম না। বুড়ি বলল, "আবার ঘুমিয়ে যাও...!" থ্রীলিং একটা সময়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভয়ের চোটে বিছানায় শুয়ে পড়লাম গিয়ে আবার। একটু পর একটা বিশাল হেঁচকি দিয়ে উঠে বসে দেখি আবার সব ঠিক, আগের মতো। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, নাহ, বুড়িটা নেই।

বিছানায় বসেই হিসাব মিলিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম ইদানিং খুব বেশি পরিমানে 'হিরোস' আর 'লস্ট' দেখা হয়ে যাচ্ছে! এই ভবিষ্যত ভ্রমনের ঘটনাটা তারই প্রতিফল। কিন্তু আবার হিসাবে প্যাচ লাগে এটা ভেবে যে আমার একসময় অনেক দেজা-ভু হতো। তখনতো হিরোস বা লস্টের চল ছিলো না। বস্তুতঃ এগুলা জানতাম ও না। সেই প্রাইমারী স্কুলের দিনগুলোতে কিছু কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে মনে হতো এখানে আমি আগেও একবার ছিলাম। এখন এটা-এটা হবে, হতোও তাই। আমি আশ্চর্য হতাম, কোনো ব্যাখ্যা জানতাম না!

ছোটবেলায় যে দুটো স্বপ্ন বেশি দেখতাম তা হলো বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তীর্ণ ছাদ, ফোস্কার মতো ফোলা ফোলা অংশ তার। তার উপর দিয়ে আমি উড়ে যাচ্ছি। পাখা-টাখা ছাড়াই আমি ভেসে বেড়াচ্ছি। এই স্বপ্নটা এখনো দেখি, কিন্তু অত ফ্রিকোয়েন্ট না।
দ্বিতীয় স্বপ্নটা ছিলো পানির নিচের। আমি পানির নিচে দিব্যি নিঃশ্বাস নিতে পারছি। চলতে পারছি, কিন্তু ডাঙ্গার মতো না। অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হতো, কিংবা পা টেনে টেনে। একবার ঘুরতে ঘুরতে একটা দালানের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম। পানির নিচের দালান। সেই প্রথম এবং শেষ, পানির নিচে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন আরও দেখলেও দালানটা আর দেখিনি।

স্বপ্ন দুটো বাস্তবায়নের চেষ্টা করা যেতে পারে কখনো। পঁচিশ-ত্রিশ তলা দালানের ছাদ থেকে আনুভূমিক লম্ফ দিয়ে দেখা যেতে পারে ভেসে থাকতে কেমন লাগে। কিংবা ভূ-মধ্যসাগরের তীর থেকে হাঁটতে হাঁটতে গভীরে চলে গিয়ে দেখা যেতে পারে নিঃশ্বাসে কোনো ব্যাঘাত ঘটে কীনা। আর সেই দালানটা, সেটারও দেখা পাওয়া যায় কীনা!

বাসী সিঙ্গারাঃ

এখানে আমার বোকাসোকা, আলাভোলা টাইপের কিছু স্বপ্নের কথা (থাকে না! ঐ যে "তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও, কী করতে চাও" টাইপের!) বলার কথা ছিলো। কিন্তু বলবো না।

পান্তাভাতঃ

এখানে কিছু একটা লেখার কথা ছিলো। কিন্তু ভুলে গেছি। সহসা মনে পড়ারও কোনো লক্ষণ দেখছি না।

Wednesday, October 29, 2008

বসন্ত যেভাবে ঋতুরাজ হলো-

শরতের আকাশ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। বছরের সবচাইতে সুন্দর আকাশ দেখা যায় ওই সময়টায়। ঘাসের ওপর সটান শুয়ে সাদা সাদা মেঘের মধ্যে পালতোলা নৌকা, হাতি, প্রিয়জনের মুখ সবই বানানো যায়। কিন্তু যখন রোদ ওঠে, পিঠে গিয়ে লাগে!

যখন 'ঋতুরাজ' নির্বাচনের ভুটাভুটি হয়, তখন ভালোলাগার দিক থেকে শরৎ বেশ কিছু ভোট পেয়েছিলোও বটে। কিন্তু ঠিক তার পরের ব্লকেই হেমন্ত নামের আগুন একটি ঋতু বাস করে বলে ঋতুরাজ হিসেবে তার কপালের শিঁকে ছিঁড়েনি। আর বড়ই আকর্ষণীয়, মনকাড়া রূপসৌন্দর্য্য নিয়েও হেমন্ত ভুটে জিততে পারেনি ঠিক তার পাশেই অমন দিল ধাকধাককরা মাধুরীর মতো মিষ্টি 'শরৎ' ছিলো বলে!

গ্রীষ্ম আর বর্ষা ভুটের রাজনীতিতে খুবেকটা সুবিধে করতে পারেনি। শোনা যায় তারা নির্বাচন কমিশনের আদেশকে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচসহ মুড়ি খাওয়ার আহ্বান জানিয়ে, বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে ইলেকশনে নয়ছয়রঙা পোস্টার ছাপায়। ঝড়-তুফান-বৃষ্টি আর কাঁদার দেয়াল লিখনে ভরে তোলে যত্রতত্র। আর্মি ইন্টেলিজেন্স তো দাবী করে ভুটের আগের রাতে নাকি 'গ্রীষ্ম' রীতিমতো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে জনগণকে 'উপঢৌকণ'ও প্রদান করে। এইযে এতো এতো ফল পাই আমরা গ্রীষ্মকালে, এগুলো তো সেই উপঢৌকণেরই বাইপ্রোডাক্ট!

শীত বেচারা একটু ম্যাদা মার্কা ছিলো ছোটকাল থেকেই। অনেকটা আমার মতো আলসে। চাদর মুড়ি দিয়ে খালি ঘুমায় ব্যাটা। অনেক চমকদার, রকমফেরী শাক-সব্জি আর সুস্বাদু খেজুরের রসের প্রত্যক্ষ সাপোর্ট থাকা সত্বেও কেবলমাত্র আলসেমীর কারণেই কিনা ইলেকশানে পিছিয়ে গেলো ব্যাটা! শালা একটা ফাজিল বটে!!

শেষমেশ টেক্কাটা মারলো সুযোগসন্ধানী 'বসন্ত'। গ্রীষ্মের নামে দুদকে দুর্নীতির মকদ্দমা ঠুঁকে তাকে হঁটিয়ে দেয় ইলেকশানের রিলেশান থেকে। গ্রাসরুটের প্রবল সমর্থন থাকা শীতের আলসেমীর বিরুদ্ধেও সে সোচ্চার, কখনো শীতল আর কখনো অগ্নিময় কথাবার্তায় কাঁপিয়ে তোলে বাংলার পথঘাটপ্রান্তর। নিজের ইলেকশনের প্রচারণার জন্য ইমপোর্ট করে উপমহাদেশের নামীদামী সঙ্গীত শিল্পী 'কুকিল'কে। কুকিল তার কণ্ঠের ইন্দ্রজালে জড়িয়ে নেয় গোটা সিলেকশনবোর্ড। সবাই সুন্দরের পূজারী। জনগণও তাদের বয়ষ্ক বউদের ঘরে রেখে চ্যাঙড়া কুকিলের জলসায় হাজির হয়। সুযোগ বুঝে বসন্ত ঘোষনা দিয়ে বসে, "ভাইসব, আপনারা আমাকে ঋতুরাজ হিসেবে নির্বাচিত করুন। আমি নিজের তহবিল থেকে খরচ করে আপনাদের ঘরে বসে কুকিলের সুকণ্ঠি অমৃত সেবনের ব্যবস্থা করে দিবো!" পটেটো সিনড্রোমের জনগণ আর কী করে! দিলো নিজের ভুটখানা বসন্তকেই।

সেই থেকেই না বসন্তকে ঋতুরাজ মানার নিয়ম!

Saturday, October 18, 2008

গুরুচন্ডালী - ০১১

প্রসঙ্গঃ দে দৌঁড়ঃ

বৈরাগী মন হলে যা হয় আরকি। ঘরবাড়ি-বিধি-বাঁধন ভালো লাগে না। মন খালি উড়ুৎ ফুরুৎ করে। সব ছেড়ে ছুড়ে ভাগা দিতে মন চায়। সবাই যেখানে সামনের দিকে দৌঁড়ায়, দৌঁড় শেষের লালফিতা ছুঁয়ে বিজয়ী হতে চায় সেখানে আমি হঠাৎ থেমে চোখ বন্ধ করে উল্টা দিকে ছুট লাগাই। কারো চিৎকার চেঁচামেচি কানে আসে না। চোখ বন্ধ হলে কানও বন্ধ হয়ে যায়। মাথায় তখন একটাই চিন্তা কাজ করে। 'দে দৌঁড়', লাগা ভোঁ-দৌঁড়!

কিছুদিন পরপর যখন সবকিছু নাসিকা পর্যন্ত ভরে যায়, যখন আর কোনো কিছু ভালো লাগেনা, যখন সবকিছু অসহ্য হয়ে পড়তে শুরু করে- তখনই সবকিছু থেকে ছুটি নিতে হয় আমার। সবকিছু শাটডাউন করে বেরিয়ে পড়ি একদিকে। কোনো উপলক্ষ থাকলে ভালো নাহলেও ক্ষতি নেই। উপলক্ষ বানিয়ে নিতে কষ্ট হয় না। অনেকদিন থেকেই একটা দৌঁড় ডিউ হয়েছিলো। সবকিছু অসহ্য লাগতে শুরু করেছিলো বেশ কিছুদিন ধরে। নানান ঝামেলায় যখন নাভিশ্বাস চরমে তখনই সুযোগটা এলো। এক সিনিয়র ভাই এলেন ফ্রাইবুর্গে, কনফারেন্সে। চলে গেলাম সেদিকে। ঘুরেফিরে তাঁকে নিবাসগামী ফ্লাইটে তুলে দিয়ে এখন খালাতো ভাইয়ের এখানে অবস্থান নিয়েছি।

হামধূম এবং হাউকাউঃ

খালাতো ভাইয়ের এখানে এলে যে জিনিষটা হয় তা হলো ভোকাল কর্ডের যথেচ্ছা ব্যবহার। সবাই চিল্লায়। কোনো কারণ ছাড়াই। আমিও চিল্লাই। হুদাহুদিই। মাঝে মাঝে ভাবীকে জিজ্ঞাসী, হুদাহুদি চিল্লাও ক্যা? আস্তে বললেই তো শুনি। ভাবী জবাব দেন, তোমার ভাইয়ের লগে চিল্লাই, ভাইস্তা-ভাস্তির লগে চিল্লাই, তুমিও মাশাল্লা কম যাও না। দশবার না কইলে কথা কানে তুলো না। অতএব, চিল্লানো ছাড়া গতি নাই, কিছুই করার নাই গোলাম হোসেন। এই যেমন এই লেখাটা লেখার সময় কম করে হলেও তিনবার আমার উঠতে হয়েছে। একবার খাওয়ার জন্য। একবার গোসল করার জন্য আরেকবার কেনো উঠছি সেটা ভুলে গেছি। এবং প্রতিটা বারেই মহাতোড়েজোরে হাউকাউ হওয়ার আগে উঠি নাই। বিনাযুদ্ধে নাহি দেবো শূচাগ্র মেদিনী। একেবারে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছি! হাসি

... এবং খোমাখাতাঃ

ফেইসবুকে বন্ধু হবার আহ্বান এসে জড়ো হচ্ছে দিনদিন। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করতাম। এখন আস্তে করে ফেলে রাখি যদি অচেনা বা আধাচেনা হয়। পুরানো কিছু বন্ধু, কিছু পরিচিত মুখ বন্ধু তালিকায় যোগ হয়েছে। কথাবার্তা চালাচালি, মন্তব্য আদান-প্রদান, বার্তা প্রেরণ-গ্রহন সবই চলে এই মুষ্টিমেয় কয়েকজনের মধ্যে।

এরই মধ্যে একদিন কানাডা থেকে মামাতো বোন জানালেন, "হুমম দেখছিরে দেখছি..."। আমি বলি কী দেখছেন? "কী আবার তোর জার্মান বান্ধবী!" আমি মনে মনে ভাবি, 'লেও হালুয়া! আমার বান্ধবী আর আমি নিজেই দেখলাম না?' চিন্তিত বেশ কয়েকপ্রস্ত জেরা-প্রতিজেরার পর বুঝা গেলো যাকে আমার জার্মান বান্ধবী বলে বোন ভুল করেছিলো সে আসলে আমার (গার্ল)বান্ধবী নয়। আমেরিকা থেকে গোয়েটে ইনস্টিটিউটে পড়তে আসা এক বালিকা। তার একুশতম জন্মদিনটাকে একটু স্মরণীয় করে রাখতে কোলনের কয়েকটা জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিলাম মাত্র! সব কিছু খুলে বলতেই বোনের মুখ থেকে "আহা" জাতীয় কিছু একটা বেরিয়ে গেলো। আর আমি মনে মনে বলি, "আমার কোনো ডোরে বাঁধা পড়া কিংবা ডোরে বেঁধে ফেলা এতোই সোজা!"
তবে খোমাখাতা নিয়ে গিয়ানজামের অবকাশ সর্বদাই রয়ে যায় আমার ক্ষেত্রে।

ধুরো হালায়...

ফ্রাঙ্কফুর্টে না কই যাইবো খালাতো ভাইয়ের ফ্যামিলি ঈদের (পূনর্মিলনী) পার্টিতে। এখন বাঁটে পইড়া আমারেও তাগো লগে যাইতে হইবো। এই নিয়া বাসায় পুরাদমে হাউকাউ। আমি শান্তিমতো একটু ব্লগামু তারও সিসটেম নাই। আমারে রেডি হওনের লাইগ্যা চাইরজনে প্রতি দশ সেকেন্ড অন্তর অন্তর তাগাদা দিতাছে। ঐ যে আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া শুরু হইছে। ধুরো বাল যাইগা....!

Wednesday, October 08, 2008

গুরুচন্ডালী - ০১০

তালাচাবি মার্কায় ভোট দিনঃ

না, কোনো নির্বাচনে প্রার্থীর প্রচারের দায়িত্ব পাইনি। খুব প্রিয় একজন মেম্বারের কথা মনে পড়ছে এই ক্ষণে। তিনি আর কেউ নন, সচলায়তন ইউনিয়ন পরিষদের মান্যবর গমচোর শালিখেলাপি মেম্বর "দ্রোহী"। অনেকদিন ধরে লা-পাত্তা তিনি। নানাজনে নানা কথা বলে এ নিয়ে। আমি অবশ্য বিশ্বাস করি, সকল স্ত্রীকুলের অগ্নিচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি পত্রপাঠ সচলায়তনে যোগ দিয়ে আমাদের বাধিত করবেন। বলাই বাহুল্য, মেম্বরের শোকে চেয়ারম্যান কঠিন জ্বর-কাশিতে ভুগছেন আর ছড়া-টড়া লিখে যাচ্ছেন। এটা অবশ্য অসমর্থিত দুষ্টলোক প্রদত্ত তথ্য! হাসি

ঈদ ও চন্দন দ্বীপের রাজকন্যাঃ

গেলো সোমবার রাতে এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। ঘুমিয়ে পড়লে অন্য বারের মতো এবারো ঈদের নামায থাকতো শিঁকেয় তোলা হয়ে। সময়মতো পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে, তাতে সুগন্ধি -টুগন্ধি মেখে, নামায শেষে জনগণের সঙ্গে জাতাজাতি-জাবড়াজাবড়ি-পাচড়াপাচড়ি করে বাসে, ট্রামে, চেয়ারে, সোফায় ঢুলঢুল করে অবশেষে নিজের বিছানায় এসে ধপাশ! পরদিন এবং তার পরদিন সুযোগ এসেছিলো হাতের রিমোট নেড়ে এনটিভি-চ্যানেল আই-এটিন বাংলা পরিদর্শনের। অনেক দর্শনীয় জিনিষের মাঝে যা মন কাড়লো তা হলো নায়ক ওয়াসিম ভাই অভিনীত চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা। প্রিয় নায়িকা অঞ্জু ঘোষ আর ইলিয়াস কাঞ্চনের কী আরেকটা ছবি ছিলো, নামটা মনে নেই। খালি অপেক্ষা করছিলাম কখন পর্দায় অঞ্জু ঘোষকে দেখা যাবে, আর তাঁর ডায়ালগ নিঃসৃত নিঃশ্বাসের ফোঁসফোঁস শব্দে কান খাড়া হয়ে যাবে! ওখানে আবার পোয়াবারো হিসেবে লাস্যময়ী নূতনও হাজির হয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। চোখ টিপি

... এবং দূরালাপনীঃ

বৃহষ্পতিবার খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেলো। একটু বুড়িয়ে গেছি বুঝতে পারি যখন দেখি শত চেষ্টায়ও আর ভেঙে যাওয়া ঘুম আর জোড়া লাগাতে পারিনা। কী আর করা, ফোন টেপাটেপি শুরু করলাম। উদ্দেশ্য ঢাকায় ফোন লাগানো। এক বন্ধুর নাম্বারে ঘুরাচ্ছি তো ঘুরাচ্ছিই। কী এক আজব সাউন্ড শোনায়, বিজি টোন নাকি লাইনই ঢুকে না- আওয়াজ শুনে বোঝার উপায় নেই। পাক্কা দেড় ঘন্টা ট্রাই করলাম একবার বাসার ফোনে আরেকবার মোবাইল ফোনে পর্যায়ক্রমে। দেড় ঘন্টা পর ত্যাক্ত হয়ে মাথার পরে কম্বল মুড়ি দেওয়ার আগে মোবাইল খুলে নাম্বারটা যাচাই করতে গিয়ে দেখি দুইটা নাম্বারেরই তিন আর চার নম্বর সংখ্যাটা জায়গা বদল করে আছে। মানে দেড়টা ঘন্টা হুদাই জলে গেলো, ঘুমানোর চেষ্টায় শুয়ে শুয়ে হাতিঘোড়া মারলেও এতোক্ষণ কাম হইতো!

এর আগে কথা হয় বাড়িতে। এটা রুটিন। প্রতি ঈদের সকালেই। প্রতিবারই ফোন করলে শুনি এইমাত্র নামায শেষ করে ঘরে ফিরলেন আব্বা। কথাহয় সাধারণ, এটাসেটা নিয়ে। এরপরের ঘটনাটা ঘটে খুব দ্রুত। আব্বার হাত থেকে ফোন চলে যায় মায়ের কাছে। প্রথম প্রথম এই পর্যায়ে দশ মার্কের ক্যুইজ দিতে হতো! কী রান্না হলো, কী খেয়েছি, কেমনে রেঁধেছি- এইসব! সাথে থাকতো ডেজার্ট হিসেবে হাউমাউ কান্না। গত কয়েকবছর ধরে এই সুযোগটা ভদ্রমহিলা পাচ্ছেন না। ফোন হাতবদল হওয়ার সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় আমার হাউকাউ। ফোন কানে তুলেই জননী তব্দা খেয়ে যান, "পোলা কি সামনে ইলেকশনে খাড়াইবো নাকি!" আধা মিনিটের মতো তুমুল হৈচৈ করে পরে জিজ্ঞেস করি, কী রান্না হলো, কে কে এলো, কে কে আসবে, ক্যামনে কী!
বেচারী আমার প্রশ্ন, পাতি প্রশ্ন, লেঞ্জা প্রশ্ন- এসবের জবাব দিতে দিতে হঠাৎ বলে ওঠেন, "চুলায় কী জানি পুড়লো রে!" আমিও চামে দিয়া বামে কেটে পড়ি।

... এবং তুমি

এবং তোমাকে বলার আপাততঃ এখানে কিছুই নেই। তুমি সচলায়তন পড়বে না, পড়লেও এই লেখার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবে না! তারচেয়ে আগে তো তোমাকে খুঁজে বের করি, তারপর নাহয় কথার ঝাঁপি খুলে নিয়ে বসা যাবে।

Monday, September 22, 2008

হাতির বাড়িতে গরীবের পা

বলাই'দা হঠাৎ অসময়ে মুঠোফোনে ফোন্দিলেন। এই লাইনখানা পড়ে সচলায়তনের পাঠকগণ যদি মনে করছেন আমি অচ্ছুৎ বলাইয়ের কথা বলছি তাহলে তাদের তরে আমি বলিষ্ঠ কণ্ঠে জানিয়ে দিতে চাই, "জ্বী হ্যাঁ জনাব। আপনি ঠিকই ধরেছেন!"

তো যা বলছিলাম। বলাই'দা ফোন্দিয়ে জানালেন তাঁর এক চাচাতো শালীর খোঁজ পাওয়া গেছে লতাপাতার সূত্রে। মিসেস বলাই আবার আমার লেখার বিশেষ ফ্যান বিধায় আমার এই দূর্ভাগা দূর্দশা দূর করতে নিজেই এগিয়ে এসেছেন। মাঝখানে বলাই'দা বারখানেক ট্যাঁওম্যাঁও করার চেষ্টা করেছিলেন বৈকি, কিন্তু ভাবী সাহেবার রক্তচক্ষু আর রান্না ঘরের কোণে বিশেষ যত্নে সংরক্ষিত চেলাকাঠটি অবলোকন করেই দমে গেলেন এবং আমাকে ফোন্দিলেন। তিনি জানালেন বাসার স্ক্যানার নষ্ট এবং ভাবী সাহেবা চাইছিলেন যেনো আমার হাতে হার্ডকপিটাই এসে পরে তাই হরকরা হিসেবে হিমুকে বেছে নিয়ে আমার কাছে বলাই'দার সেই লতাপাতায় জরানো চাচাতো শালীর ফটুক খানা প্রেরণ করেছেন। এইখানে পাঠক যদি মনে করেন আমি সচলের মোটারাম হিমু'র কথা বলছি তাহলে বলবো, জ্বী না জনাব, আপনার ধারণা আংশিক রঙ্গীন ও বাকীটা ভুল! এই হিমু আমার দোস্ত হিমু, যাকে দেখতে হলে প্রখর রৌদ্রের মাঝেও আপনাকে দেড় ব্যাটারীর টর্চ হাতে রাখতে হবে!

হরকরার জায়গায় হিমুর নামটা শুনেই আমার মনের দূর্দশার দরজা সমানে কড়া নাড়তে লাগলো। আমার উশখুশ ভাব লক্ষ্য করে বলাইদা হেতু জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, 'বলাই'দা করছেন টা কী! আমি আমার নিজের বউরে দিয়া দোস্ত হিমুরে বিশ্বাস করতে পারি কিন্তু কারো শালী দিয়া না। ব্যাটা পুরা এলজিডি আমলা-মন্ত্রীদের মতো আমার জন্য পাঠানো ফটুকখানা আত্মসাৎ করে না দিলেই হয়!

শুনে বলাই'দা হাসলেন। বললেন, এই সাহস যাতে হিমু না পায় সেজন্য পাহারাদার হিসেবে বদ্দাকে সঙ্গে পাঠানো হয়েছে। তিনি মুরুব্বী মানুষ, দেখেশুনে রাখবেন! বদ্দার কথা শুনে কিঞ্চিৎ ভরসা পেলাম বটে, কিন্তু মনের কুডাক ডাকা আর সরে না। নামের মাঝেই কেমন বদ-বদ একটা ব্যাপার আছে। বদ্দা যদিও বেসিক্যালী আপাদমস্তক ভদ্রলোক কিন্তু হিমুর পাল্লায় পড়ে কে যে কখন কী করে বসে বুঝা দায়! যদি দুইজনেই গোপন পরিকল্পনায় ফিফটি-ফিফটি শেয়ারে ফটুকটা হাপিশ করে দেয় তাইলে!

এরকম সাতপাঁচের প্যাচ নিয়ে ভাবতে ভাবতে উড়নচণ্ডীর বেশে গিয়ে হাজির হলাম স্টেশনে বলাই'দার জানানো সময়মতো। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো বদ্দাকে দেখে যতোটা ভালো লাগলো ঠিক ততোটাই পিলে চমকে উঠলো কুঁজো হয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ানো বদমাশ হিমুটাকে দেখে। আমি বুঝে গেছি, ঘাপলা একটা হয়েছে। সেটা যে কী, এটাই এখন উদ্ধার করার পালা।

কাছে যেতেই হিমু হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। দোস্ত তুই আমারে মার, আমারে কাট, কাইট্যা বুড়িগঙ্গায় ভাসায়া দে!
আমি বলি, অই শালা, এই বিঁভুইয়ে বুড়িগঙ্গা পামু কই! বি প্র্যাকটিক্যাল ম্যান।

হিমু টি-শার্টের কোণা তুলে চোখ মুছে বলে তাইলে রাইনেই ভাসায়া দে দোস্ত....!

বদ্দা এবার ধমক দিয়ে বলেন, মেয়ে মানুষের মতো ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করো ক্যান মিয়া? খুইলা কও যা হইছে!

হিমু শুরু করলো, বদ্দা বয়স্ক মানুষ।

বদ্দা, বেনী দোলান।

এতোদূর জার্নীর ধকল সইতে না পেরে মাঝপথে গেলো ঘুমায়া। এমন সময় আমাদের পাশের সীটে আসলো দুই হিস্পানিক তরুনী। উফ এক্কেরে সেইরম উহুলালা টাইপের...।

আমি বাগড়া দিলাম, "রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করুন। রোজার দিনে খারাপ কথা ুদাইবেন না জনাব!"- এগুলা বিটিভিতে দেখস নাই ব্যাটা?

হিমু নিজের ভুল বুঝতে পেরে জিভ কাটে, উপপস... এন্টশুলডিগুং।

আবার শুরু করে, তো হিস্পানিক তরুনীদের দেখে আমার সেইরম কিছু ইচ্ছা শুরু হইলো। টুকটাক হিস্পানিক জানি বিধায় হুইসস্পার করে তাদের কানের কাছে বলতেই তারা আমার হাত ধরে নিলো সখা ট্রেনের খালি কামড়ার দিকে।

বদ্দা কই? আমি উত্তেজিত।

হিমুর জবাব, তখনো ঘুমায়!

আমি বলি, গরমের আঁচ লাগে না?

হিমু বলে, মনেহয় না। কারণ রুশ দেশে মনেহয় বরফ পড়া শুরু হইয়া গেছে।

হিমু বয়ান করে চলে। খালি কামড়ায় নিয়ে আমাকে একজন জাপটে ধরলো। আমি মনের খুশীতে চোখ বুজে বগল বাজানো শুরু করলাম। বাকীজন আমার প্যান্টের পেছনের পকেটে যেখানে মানিব্যাগ আছে সেখানে হাতাহাতি শুরু করলো। আমি ব্যাপারটা উপভোগ করতে থাকলাম। উপভোগের চরমে পৌছে আমি যখন ইডেনের পেয়ারা গাছের দিকে হাত দিতে যাবো তখন খেয়াল করলাম কখন যেনো আমাকে দুই হিস্পানিক তরুনীই আলগা করে রেখেছে। মানে তাদের কোনো স্পর্শ পাচ্ছি না। ইডেনের সুখ ছেড়ে ঢুলুঢুলু চোখ খানিক মেলতেই টের পেলাম হিস্পানিক তরুনীদয় পালিয়েছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে আমার সর্বস্ব... ইঁইঁইঁইঁ...

ধমক দিয়ে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচানি কান্না থামালাম। ইতোমধ্যে বদ্দা হিমুর মাথা নিজের কাঁধে নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে, থাক থাক আর কাইন্দ না। কাসেলে ফিরা গিয়া ফ্লোমার্কট থাইকা আরেকটা কিইন্যা দিমু নে!

আমি বুঝিনা কী কিনে দেবার কথা বলেন বদ্দা। জিজ্ঞেস করি, বলাই'দা যে বললো, সেই জিনিষ কই!

এবার বদ্দা ক্ষেপে গেলেন আমার সঙ্গে। তুমি বাড়া বাংলা বুঝনা? পোলাটা কানতাছে কি হুদাহুদিই?

ধমক খেয়ে চুপসে গেলাম। কিন্তু মাথায় তখনো ঢুকছেনা, বলাইদার লতাপাতা চাচাতো শালীর ফটুকের সঙ্গে হিস্পানিক তরুনীর পালিয়ে যাওয়ার সম্পর্কটা কোথায়! হিমুই বা কাঁদে ক্যান? আর কথা বাড়ালাম না। বদ্দার ঝারি যারা খান নাই তারা বুঝবেন না কেনো আর কথা বাড়াই নাই!

স্টেশন থেকে বের হয়ে বাসস্টপের দিকে যেতেই হিমু হঠাৎ বজ্রাহতের মতো ঠাঁয় হয়ে গেলো! বদ্দাও। কোনো এক কালের লিজেন্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সাক্ষাতের ধকল তারা সইতে পারবেন কেনো? বাংলাদেশের এযাবৎকালের সকল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর শ্বেতপাথরের নাম ফলকে এই লিজেন্ডের নাম প্রথম পাঁচ নম্বরে জ্বলজ্বল করে। মহাকামেল ব্যক্তি!

দেরী হলেই এই কামেলের কামিলতি দেখতে হতে পারে এই ভেবে সামনে দাঁড়ানো বাসে চড়ে বসি তিনজনেই। গন্তব্য অজানা। এই অজানা গন্তব্যে পৌঁছে দেখা মিললো লিটন ভাইয়ের। লিটন ভাই ব্যস্ত মানুষ, তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন কিছুক্ষণের মাঝেই। যাওয়ার আগে অবশ্য আলাভোলা লিটন ভাইকে ধরে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে অমিয় সূধা পান করিয়ে ফেললো হিমু। বেচারা লিটন ভাই ঐ অবস্থাতেই পগারপাড় হলেন!

তার পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত ও বর্ণনামুক্ত। আমাকে দিয়ে বিখ্যাত খিচুড়ি রান্না করিয়ে নিজের উদরপূর্তি করে ফিরতি ট্রেনে চেপে বসলো দোস্ত হিমু। ট্রেনে তুলে দেবার আগে যেইনা ফটুকের কথা তুলতে যাবো অমনি আবার কান্না শুরু হয়ে গেলো বেচারার। এই দেখে বদ্দা তেড়ে এলেন। কিছু বলার আগে আমি নিজেই বলে ফেললাম, "আমি বাড়া বাংলাও বুঝিনা!" :(

ট্রেন ছেড়ে দিলো। আমি একাকী স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসলাম। মনের কোণ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেলো, "ইশ, আর এই ইট্টুনির লাইগ্যা...!"

Friday, September 19, 2008

অপেক্ষা

ফুচুৎ করে লাইটার জ্বেলে অগ্নিতাহুতি করি সিগ্রেটের মুখে। এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা ঠিক কোন স্থান, কাল বা অবস্থান, বুঝে উঠতে পারি না। কীসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি সেটাও বোধের এ্যান্টেনায় ধরা পড়ে না। বাঁ হাতের কব্জি কানের মুখে নিয়ে টের পাই টিকটিক শব্দের সঞ্চালন। মহাকালের স্রোত। মনে পড়ে রুবী রায়, দুপুরের রোদে, বাস থেকে নেমেই একাকী কোনো কিশোর। কিংবা কফি হাউজের সেই সাতটা খালি চেয়ার কানের কাছে সযতনে ফিসফিস করে। ঠান্ডাটা জমে উঠছে। উঠুক না। গনগনে সূর্যটা জমে বরফের চাঁই হয়ে যাক। ধানের আস্ত তুঁষ সরিয়ে সেই বরফ কেটে ইফতারীর আগে কাগজি লেবু কচলে শরবত বানাতে চাইলে কেউ বানাক। পরনের লুঙ্গির গিঁঠ খুলে মেদালু ভুঁড়িতে সেটা পুনরায় জড়িয়ে নিতে নিতে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা আংশিক ছোলা ইত্যাদি জিভ দিয়ে খুঁচিয়ে বের করে 'থুঁ-তু' করে ফেলে দিয়ে নেমে আসুক সফদর আলীরা মসজিদের বারান্দা থেকে। ঢাকের ধমাধম শব্দে উলুধ্বনিতে কেঁপে উঠুক মা দূর্গার প্রতিমা। রবিবার বিকেলে ঢংঢং বেজে উঠুক সেন্ট্রাল চার্চের বিশাল ঘন্টা, গেয়ে উঠুক একদল সূক্ষ্ন তরুণ কণ্ঠ, "আমি প্রভুরও দাসী"। গাছের পাতা সব ঝরে যাক, সাদা চাদরে মুড়ে যাক চারদিক। শুরু হোক রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে-অন্তরীক্ষে লাল আলখাল্লা-ঝুটি টুপি আর শুভ্র শশ্রুর আনাগোণা। অথবা স্থানীয় তাঁতের পাতলা চাদরে মোড়া কারও দৃষ্টি আকর্ষনী চেষ্টা, "বা-জান, দুইটা টেকা সাহাইয্য দিবেন!"
নিশ্চুপ, ঠাঁয় দাঁড়ানো আমি। নিস্তব্ধ চারিদিক, এইবেলা। অপেক্ষায় আছি, বা রেখেছি, নিজেকেই...

Tuesday, September 02, 2008

আমার ছেলেবেলাঃ ডিলিটেড সীন - "হাসিনা তুই যা'গা..."

ফোর এর শুরুর দিকে বন্দর উপজেলা ক্যাম্পাসে নতুন সংযোজন হলো শ্যামলদের পরিবার। শ্যামল আমার বয়সী, একই স্কুলে, একই ক্লাসে ভর্তি হলো। তার ছোট বোন হাসিনা, বিএইচএমএইচ। হেমায়েত আংকেল, মোটাসোটা গড়নের গোলগাল সাইজ। কিন্তু আন্টি- উহুলালা! একেবারে সেইরম!

শিক্ষা অফিসার আংকেলের পরিবারের সঙ্গে শ্যামলদের খুব আন্তরিক সম্পর্ক হয়ে যায় খুব অল্প দিনেই। এই নিয়ে আমাদের পোলাপানদের মাঝে শ্যামলের অনুপস্থিতিতে নানা গুজব ভাসতে শুরু করে। টি.ও আংকেলের ছোট ছেলে খোকন ভাইয়ের (তৎকালীন এসেসসি পরীক্ষার্থী) সঙ্গে নাকি ছাদের চিলে কোঠার চিপায় অন্তরঙ্গ অবস্থায় উহুলালা আন্টিকে আবিষ্কার করে তৌফিকের চাচাতো বোন রুনী! সেই শুরু হয় উহুলালা আন্টিকে নিয়ে আমাদের পোলাপাইনের মাঝে তুমুল উত্তেজনা। কেমনে, আসলেই কেমনে কী!!

আমার এই লেখা অবশ্য সেই উহুলালা আন্টিকে কেন্দ্র করে না। পরের কোনো পর্ব আসলেও আসতে পারে, কইতার্তারিনা। শ্যামলের ছোট বোন হাসিনাকে নিয়েই ছোট্ট বেলার স্মৃতিটুকুর ঝাঁপি খুললাম এবার।

বিকাল হলেই আমরা নানান কিসিমের খেলা শুরু করি। একটা চিরাচরিত খেলা শুরু হয়ে সেটা বিবর্তিত হতে হতে কিম্ভূতকিমাকার রূপ ধারণ করে ফেলে আমাদের পাল্লায় পড়ে। রোজ রোজই আমরা নতুন খেলা আবিষ্কার করে সন্ধ্যা বেলায় বাসায় ফিরি। আমাদের বসয়ী মোটামুটি ৫-৭ জন শয়তানের পশ্চাৎদেশে রেগুলার ডাং মারে। সমবয়সী বা টেমাটোমা সাইজের কোনো বিপরীত লিঙ্গ না থাকায় মাঝে মাঝেই সব কেমন পানসে পানসে লাগে। শিমু আপা, যুঁথী কিংবা জেসমিন আপারা যখন সবাই মিলে খেলে তখন আমাদেরকে দুধ খাইয়ে ভাতের প্লেট হাতে ধরিয়ে সাইড লাইনের ঐপাশে বসিয়ে রাখে। বাধ্য হয়েই আমরা ক্রীড়াঙ্গণ ছেড়ে সারা উপজেলা চত্ত্বর ঘুরে বেড়াই। ডাব গাছের দিকে তাকিয়ে ভাবি, কবে যে আরেকটু বড় হবো! আর ঐ যে বললাম খেলার বিবর্তনকরণ, সেটা চলতে থাকে রেগুলারই। তো এরই মধ্যে যখন শ্যামলরা এলো, আমাদের আর পায় কে।

এখন আমরা ভুলেও বড়দের ঐদিকে যাই না। আমরা আমরাই খেলি। তৌহিদ, জুয়েল, শরীফ, তৌফিক, দিদার, আমি, শ্যামল এবং শ্যামলের ছোট বোন হাসিনা। খেলা যেরকমই হোক, হাসিনাকে সবাই মিনিমাম একবার করে জড়িয়ে ধরবেই। এটাই খেলার নিয়ম। এভাবেই চলে আমাদের প্রতিদিনের খেলা আবিষ্কার।

তৌহিদ ছিলো আমাদের মধ্যে সবচাইতে পোংটা। কী সব ফটুক ফাটুক দেখাতো তখনই। বোম্বের হট নায়িকার হাটু খোলা ফটুক দেখিয়ে আমাদের থেকে পয়সা আদায় করতো সে। হালায় একটা খাছড়া পাবলিক! তো যাই হোক, একদিন বিকেলে যথারীতি খেলা শুরু হলো। শুরুটা হয়েছিলো টিলোএক্সপ্রেস দিয়ে। সেটা বিবর্তিত হয়ে হয়ে গেলো বরফপানি। সবাই খালি হাসিনার পেছনে দৌড়ায়। এবার বরফপানি বিবর্তিত হলো লুকোচুরিতে। লুকানোর জায়গা হলো বিশাল বিশাল নারিকেল গাছ। সারা চত্ত্বরের সব গাছ ফাঁকা থাকলেও কেবল একটা গাছের পেছনেই বিশাল জ্যাম লেগে থাকে। কারণ ঐ একটাই। কারণ ঐখানে হাসিনা পলাইছে!

একবার এই ধারা পাল্টিয়ে শ্যামল তার বোনের পেছনে লাইন কমাতে নিজেই গিয়ে আগেভাগে দাড়িয়ে গেলো একটা নারকেল গাছের গোড়ায়। তারপর তৌফিক এবং তারপর পোংটা তৌহিদ। আমরা একে একে পেছনে। হঠাৎ খেয়াল করি পোংটা তৌহিদের নিম্নাংশ একবার সামনে যায় আবার পেছনে আসে। ঘটনা কী! ওর সামনে তৌফিক, একটু ভোম্বল কিসিমের, ও চিল্লায় "এই শালা করোস কী!", সবার সামনে থেকে শ্যামল চিল্লায়, "ঐ ব্যাটা নরোশ ক্যান, দেইখা ফেলবো তো!" এদিকে পোংটা তৌহিদ পুরোদমে সরলদোলকের মতো নড়াচড়া শুরু করেছে। শ্যামল যখন বুঝতে পারলো পেছন থেকে কী হচ্ছে হুড়ুৎ করে বের হয়ে সবার পেছনে সরে এসে সেও শুরু করলো পোংটা তৌহিদের মতো একটিভিটিজ। এভাবে একজন করে পিছলিয়ে বের হয় আর পেছনে এসে যোগ দেয়। ততোক্ষণে লুকোচরি খেলা বিবর্তিত হয়ে এই নতুন খেলার সৃষ্টি হয়েছে, কে কাকে পেছন থেকে ঠেলতে পারে!

এই ঘটনা হাসিনার চোখ এড়ালো না। ও ভাবলো বাহ্ বেশতো! ও নিজেও যোগ দিলো এই খেলায়। এইবার পোংটা তৌহিদ এই লাইন ছেড়ে হাসিনার পেছনে গিয়ে দাড়িয়ে গেলো। আর এটা দেখে শ্যামল চিৎকার করে উঠলো, "হাসিনা তুই যা'গা, তোরে পুটকি মারবো!"

Thursday, August 28, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০৯

০১।

বহুদিন পরে পরানের দোস্তের দন্তমোবারক দেখার সৌভাগ্য হইছে। সেই গুড়াগাড়া বেলায় বাণিজ্যমেলায় গেলে কিংবা কোনো গ্যাদারিং ফ্যাদারিং সংক্রান্ত জায়গায় গেলে তারে বলা হতো তুই যেইখানেই থাকস দন্তবিকশিত হাসি ঝুলাইয়া রাখবি তোর মন্ডলমুখে। এছাড়া তো তোরে চৈত্রমাসের ভর দুপুরেও চর্টলাইট মাইরাও খুঁইজা পাওন যাইবো না।

আমি জিগাইলাম অ দোস্ত দ্রুইট পাহাড় কোনদিকে রে!
দোস্ত জানায়, এইতো দুই ইশটপ পরেই। ক্যা!
আমি বলি এমনেই। কিন্তু কথা হইলো ঐ পাহাড় এপিং পিপিং ছাড়ায়া কালো শহরের দিকে আসলো ক্যামনে?
দোস্ত কয়, কি আবোল তাবোল কস হালার নাতি। হারা দুনিয়া গাড়ি চালায়া ভাইজা খাইলি আর অখন কস ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী কবে থাইকা! তুই কি নীল পাহাড়ের কথাও ভুইলা গেলি নাকি!
আমি এইবার কনফিডেন্ট জবাব ছুড়ি, তা ভুলুম ক্যা হালায় ভূষা। ঐ জিনিষ তো পিপিং লাইনেই!

আমার এই কথা শুইনা দোস্ত আমার হাসতে হাসতে টাশকি খাইয়া যায় আরকি! আমি বেক্কলের মতো নাক ঘঁষতে থাকি। কয়, ঠান্ডা কলের তলে মাথা চুবাইয়া রাখ। ঠান্ডা হইবো!

বুঝলাম ৭ বছর অনেক লম্বা একটা সময়। মাথার ঘুলিঘুপচিতে ফাঁড়ি রাস্তা, সদর রাস্তার মানচিত্র আঁকা থাকার কথা থাকলেও আদতে তা নাই। কখন সেগুলা ম্যালফাংশনের কবলে পইড়া লাইন-বেলাইন হইয়া গেছে সেটা টেরও পাই নাই!

০২।

ভ্রমনরত খালাতো ভাইয়ের সম্মানে পুরা জ্ঞাতিগুষ্ঠি গেছিলাম এমিউজমেন্ট পার্কে। যতোটা টাশকি খাওয়ার কথা আছিলো ততোটা খাই নাই। ক্যান খাই নাই সেইটা লাখ টাকার প্রশ্নো। পল্টি খাওয়া রোলার কোস্টারের চেহারা মোবারক দেইখা ঐদিক দিয়া হাঁটা দেই নাই ভুলেও। ছোট ভাই আর ভাতিজা কয়েকটন পরিমান আনন্দ নিয়া বার কয়েক ঐটাতে চইড়া আসছে। আর নরমাল রোলার কোষ্টার তো পানিভাত!

"ভাসারবান", রোলার কোস্টারের পানির ভার্সন। এইটা ততোটা "ডেন্ডারাস" না মনে কইরা ভাস্তি সহ গেলাম। ভাই আর ভাবী গেলো না। তো লাইন দেখি দুইটা। একটা ওয়াইল্ড আরেকটা স্টোন। আমি তো আর জম্মন ভাষা খুবেকটা বুঝি না। ছোট ভাই দেখে শুনে ভ্রমনরত খালাতো ভাই, আমার ভাস্তি আর আমারে ওয়াইল্ড লাইনে রেখে নিজে আর ভাইস্তা কেটে পড়লো স্টোন লাইনের দিকে। বললো আমাদেরটাই নাকি অপেক্ষাকৃত সহজ।

নৌকার আদলের কোস্টার যাত্রা শুরু করলো। কোন এক ঘুরপথে টুকুশ করে একটা ছবিও উঠে গেলো। সামনে খালাতো ভাই, তারপর ভাস্তি আর একদম পেছনে আমি। ভাস্তি সাইজে তেলাপোকা টাইপের হওয়াতে আমার দুইহাত দিয়ে সীটবেল্টের মতো আটকে রেখেছি। মজাই হচ্ছে। হঠাৎ দেখি সামনে বিশাল বড় খাদ। আমি এই খাদ দেখে ভয়ের চোটে দোয়াদুরুদ পড়াও ভুলে গেলাম। খাদের কিনাড়ায় এসে আর কিছু মনে নেই। যখন সম্বিৎ ফিরলো তখন শুনি ভাস্তি বলতেছে, "চাচা আমি তো পুরা উড়াল দিতাছিলাম!" আর আমি ভাবি, প্রায় সোজা হয়ে পড়ন্ত ঐ নৌকায় যদি কোনোমতে আমার হাতটা ফস্কে যেতো তাইলে কী অবস্থাটা হইতো!

এই ঘটনার অবশ্য শোধ নিছিলাম দুইটা ঘটনা ঘটিয়ে। ঘটনা এক. বিশাল বড় ফ্যামিলি নৌকায় যেখানে বেশ বড় এ্যাবড়ো থেবড়ো পানিপথ পাড়ি দিতে গিয়ে নিজেকে প্রায় গোসল করায়ে বের হতে হয়, সেখানে মাঝপথে বিশাল ঘিরিঙ্গি টাইপের একটা 'পাদ' মেরে। আমাদের সঙ্গী কয়েকজন বিদেশী আরোহীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা দেখে মনে যে আনন্দ পাইছি সেইটা ঐ নৌকায় নিজেরে কাকের মতো ভিজে চুপচুপা অবস্থায় আবিষ্কার করার বিরক্তির বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।

দ্বিতীয় ঘটনাটার বলি ছিলো আমার সিধামিধা খালাতো ভাই। বেচারা জানখান্দান করা কোনো রাইডেই চড়ে নাই। ট্রেন, চড়কিগাছ এইসব ননহার্মফুল বাহনে উইঠা প্রবল তৃপ্তিতে ঢেঁকুর তুলতে সে যখন মত্ত তখনই তারে নিয়া ঢুকলাম রহস্যময় প্রাসাদে। ঢুকার পথেই এক কিম্ভুতকিমাকার ছদ্মবেশধারী কেউ খালাতো ভাইকে এমন ভয় পাইয়ে দিলো বেচারা আরেকটু হলেই যায় আরকি!

নানা চিপাগলিটলি ঘুরে শেষে গিয়ে হাজির হলাম বিশাল এক হল ঘরে। এখানে দেয়ার ধরে অনেক গুলো চেয়ার সাজানো। চেয়ারের ওপর থেকে আবার শক্ত বেল্টের মতো জিনিষ ঝুলানো। বুঝলাম এইটাই সেইটা! ফ্রী-ফল। একটানে কয়েকশ ফুট উপরে তুলে নিয়ে আস্তে করে ছেড়ে দেয়। ব্যস এইবার বুঝ ফ্রী-ফল কী জিনিষ! ভাইস্তা আর আমি মোটামুটি পিছলাইয়া বের হয়ে আসলাম হল ঘর থেকে। ছোট ভাই রয়ে গেলো। আমার পেছন পেছন দরজা পর্যন্ত এসে খালাতো ভাই বলে কই যাস! বেচারা তো ভাষাবুলি কিছুই বুঝে না। আমি বললাম আমার বাথরুম পাইছে। আপনে থাকেন। ঐযে বগা আছে, বগার সাথে গিয়া বইসা থাকেন। এইখানে মনেহয় থ্রি-ডি সিনেমা দেখাবে। বেচারা হাতের ব্যাগ আমার কাছে রেখে ফিরে গেলো আর ঠিক তার পরপরই সেই হল ঘরটার বাইরের দিকের দরোজাটা গেলো বন্ধ হয়ে। ভাইস্তা বলে, চাচা না ডরায়, হার্ট এ্যাটাক করলে? জবাবে আমি বলি, কেবল আল্লাহরে ডাক এখন!

Thursday, August 14, 2008

আই বিলিভ, আই ক্যান ফ্লাই...

০১.
ডেস্কটপটা হঠাৎ করে চোখ উলটে দিলো সেই কবে। আলসেমি করে তার গায়ে আর হাত বুলানো হয় নি। ছোট ভাইটার এডমিশন হলো একটু দূরের শহরে। একা থাকাটা কষ্টকর, বুঝি বলে সঙ্গে ল্যাপটপটা দিয়ে দিলাম। ঘরে নেট নাই। টায়ার্ড ও থাকি চূড়ান্ত। রাতে ফিরেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি। এক সময় ঘুমিয়ে যাই। সচলে আগের মতো সময় দিতে পারি না। একটা ব্যবধান তৈরী হচ্ছে বুঝতে পারি, কিন্তু করার থাকে না কিছুই।

খালাতো ভাই এসেছে তার বড়ো ভাইয়ের কাছে বেড়াতে এক মাসের জন্য। সেদিন গেলাম দেখা করতে। কেমন ন্যাতানো মনে হলো। বুঝলাম মানচিত্রের সীমানা খুব বড় একটা ফ্যাক্টর ফেলে মানুষের মধ্যে। আমরা তিনজন বাইরে থেকে ফিরছি। বাসায় ঢুকার পথে জানতে পারলাম খালাতো ভাইয়ের জার্মান শাশুড়ি এসেছেন মেয়ের বাসায় বেড়াতে। বেড়াতে আসা খালাতো ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'মায়ই কে দেখে কী করবেন'। আমি বললাম, "তিনি জার্মান হলেও আমাদের কালচারের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল। আপনি পায়ে ধরে সালাম করতে পারেন। আমিও করেছি। বিশ ইউরো বখশিষ ও পেয়েছি। বুঝলেন, খুব ভালো মহিলা।"

এর দুই মিনিট পরে যা ঘটলো তার ইমপ্যাক্ট আমার উপরে আসার আগে আমি লা-পাত্তা। খালাতো ভাই ঘরে ঢুকেই ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা আমাদের মায়ই মা'র সামনে ঝুঁকতে ঝুঁকতে একসময় খপ করে পা ধরে ফেললো এবং যথারীতি বাঙালী স্টাইলে কদমবুচি শুরু করলো। বেচারী মায়ই মা, জীবনেও এরকম অবস্থায় পড়েন নাই বোধ করি। হেই হেই করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেললেন। খালাতো ভাই তখনো তাঁর পা ধরেই আছে!

০২.
বছরে একটা দিনের সন্ধ্যায় আমার ম্যানলী'র রিবস এণ্ড রিবনের কথা মনে হয়। ম্যানলী হলো সেই জায়গা যেখানে মিনিস্কার্ট পরা প্রীতি জিনটা আর পাংকুকাট আমির খান সেই বিখ্যাত "বুঝিনা হালায় লোকজন যে পীরিত করে ক্যান" গানটা গায়। রিবস এণ্ড রিবন, এখানে যাওয়া এবং খাওয়ার মতো স্বাস্থ্য আমার পকেটের কোনো কালেই ছিলো না। অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আসার ঠিক আগের দিন। আমার কাছের কলিগেরা মিলে আমার জন্য সেখানে একটা পার্টি ছুড়ে দেয়। কারণ অবশ্য আরো একটা ছিলো। দিনটা ছিলো ১২-ই আগস্ট।

সেদিনের সেই সন্ধ্যায় মাইকের সাথে যখন রিবস এণ্ড রিবনে পৌঁছাই তখন সেখানে উজ্জল মুখের আট-দশজন উঠে হাত মিলিয়েছিলো, বার্থডে উইশ করেছিলো। সময়ের সাথে সেই মুখগুলো হারিয়ে গেলেও অনুভূতিটা এখনো রয়ে গেছে সতেজ। এই যেনো একটু আগেই ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা!

সেই ১২-ই আগস্ট থেকে এই ১২-ই আগস্ট। আমি বড়ো হয়েছি, বুড়ো হয়েছি, বুড়িয়েও গেছি হয়তো খানিকটা! অনুভূতিগুলো রয়ে গেছে তরতাজা। এর মধ্যে প্রতিটা ১২-ই আগস্ট স্বতন্ত্র হয়ে একটা বোর্ডে লাল-নীল আলপিনে আঁটা হয়ে আছে। বোর্ডের দিকে ঘুরে তাকালে একেকটা ঘটনা, একেকটা হাস্যোজ্জ্বল অবয়ব হাতছানি দেয়। আমি উড়ে যাই, খোলা মনের জানালা দিয়ে। উড়ি, ডিগবাজী খাই শূন্যে ঠিক গেরোবাজ কবুতরের মতো। বাস্তবতার সূতার টানে ফিরে আসি আবার, খোলা জানালাটা বন্ধ করে দেই সন্তর্পণে, পরের বছর এই দিনে আবার ডানা ছড়িয়ে উড়াল দেবার প্রত্যাশায়!

মুমু আর স্বপ্নাহত (ওরফে জিহাদ)। আমার খুব প্রিয় সচলদের দুজন। এবার জানালা খোলার কাজটা এই দুজন করেছে। জানালা খোলা পেয়েছি, দৌড়ে বের হয়ে গেছি সেই খোলা জানালা দিয়ে, উড়ে বেরিয়েছি দিনমান, একদমই নিজের মতো করে। আমাকে এই অসামান্য সুযোগটুকু করে দেবার জন্য হের্সৎলিশেন ডাংক মুমু এবং জিহাদ।

গত দুই বছরে এমন অনেক শুভানুধ্যায়ী, বন্ধু মিলেছে যাদের বেশিরভাগকেই এমনকি এই জীবনে কখনো দেখিওনি। এই বন্ধুরা আমাকে আমার বিশেষ দিনটিতে নানাভাবে শুভাশীষ জানিয়েছেন, আমাকে কৃতজ্ঞতায় অভিসিক্ত করেছেন। ফিলেন ডাংক! ফিলেন ফিলেন ডাংক!!

Friday, July 25, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০৮

নেট এর যন্ত্রণা নাকি উইন্ডোজ বিশ্ঠার ভারে আমার কম্পুখানাই গেছে, সেইটা এখনো ধরতে পারতেছি না। কোনো এক পেজে টিবি দিয়া এক পশলা ঘুমের শট মাইরা উইঠা আবার দ্বিতীয় টিবি দেই। এমনেই চলতাছে, চলবো কতোদিন সেইটাও বুঝতে পারতাছি না।

কালকে রাতে তাইরে নাইরে নাই করে ঘরে ফিরে এমএসএনে লগ ইন করছি ব্যাক এন্ডে। ফ্রন্ট এন্ডে চিন্তা করতেছিলাম নানান গ্যাড়াকলে পইড়া অনেকদিন ছাই-ভষ্ম কিছু লেখা হইতেছে না। কী লেখা যায় এই নিয়া যখন ভাবতেছিলাম ঠিক সেই মুহূর্তে ব্লগার্টুনিস্ট সুজন্দা দিলো টোকা। কয়, 'সচলায়তনের ব্যানরে ঐ ব্যাটা এমনে হা কইরা রইছে ক্যান'!

সুজন্দার ঐ কথা শুইনা উড়মান আমি পড়লাম টুক্কুশ কইরা মাটিতে পইড়ে গেলাম। "কন কী দাদা, আপনে বানান নাই তাইলে! চামে চামে দিলাম আমার দোস্তের ঘাড়ে দোষ চাপাইয়া। এই ব্যাটাই নিশ্চই বানাইছে খামখাম টাইপের এই মুখ!"

শুনে সুজন্দা বলে, টু মুখপোড়াস আর বেইকিং পটেটো হোয়াইল সচলায়তন ইজ অন ফায়ার- এইটা ট্রান্সলেশন করতে! পরীক্ষায় কমন পড়ার খুশিতে জাম্প দিয়া মাটিতে নাইমা আসি। তখন আবার দেখি আড্ডাবাজ খোঁচায়। আমি কই, দাদা কোবতে লেখি! বলে শোনাও। শোনাইলাম। সুজন্দা বলে, বাকীটা কই? আমি কই লেখতাছি। কয় লেইখা ব্লগে দিয়া দ্যাও। আমি কই, জো আজ্ঞা!

তো সেই থাইকাই নিদারুণ চেষ্টা করতেছি আমার কোবতেখানা জনগণের সমীপে প্রকাশ করার। কিন্তু পরে খেয়াল হইলো পান্ডুলিপি তো নাই আমার, ব্লগে দিমু ক্যামনে! তখন খিয়াল হইলো, হিমু প্রমুখ দূর্মুখেরা আমাদের কান ঝালাপালা করে নানান পদের গান অডিও করে খাওয়ায়। আমি কেনো আমার কোবতেকে নয়াস্টাইলে ভিডিও আকারে উপস্থাপন করবো না!

ইউটিউবের হাতে পায়ে ধইরা ৩১ মেগার ভিডিও খানা আপলোডাইলাম ঠিকই মাগার দেখতে আমি নিজেই পাই না। ক্যান পাইনা সেই গল্পই প্রথমে করতেছিলাম। চাক্কা ঘুরে তো ঘুরেই। (কোনো সুহৃদয় ব্যক্তি বিশাল ফাইলরে পুচকী বানায়া ইউটিউবে দেওয়া পন্থা জানাইলে বাধিত হইতাম!) ইস্নিপসে তুলতে গেলাম, কয় সন্দিহান ব্যাপার স্যাপার। আমার নিজের কম্পুতে করা ভিডিও ক্যামনে সন্দিহান হয়, বুঝলাম না!

দেখতে পারা যাক আর না যাক ভিডিওখান শেয়ার করলাম আপনাদের সঙ্গে। যেহেতু কোবতেখান আমি ল্যাখছি, তাই জগদ্বিখ্যাত হওয়ার চান্স অনেক বেশি। কেউ অটোগ্রাফ নিতে চাইলে এখনই চাইতে পারেন। পরে আমি বিখ্যাত হইয়া গেলে কৈলাম আর চান্স পাইবেন না, এই আমি কয়ে দিনু!

Wednesday, July 02, 2008

গরমের কিচ্ছা

গরমে জান খান্দান!

২০০৬ এর পরে এই প্রথম আউলাটক্কর গরম পড়ছে। গরম কি গরম, যেমন তেমন গরম? পরনের কাপড় খুলে ম্যারাথন না হলেও ৪০০ মিটার রীলে দৌড় দিতে মন করতেছে।

এজ ইয়্যুজুয়াল তাড়াহুড়ায় হাতের কাছে পাওয়া টি-শার্টটা পরেই বেরিয়ে গেছি ঘর থেকে। এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীর অষ্টমাভুলের একটা হয়েছে এইটা, সিনথেটিকের টি-শার্ট পরাটা। মনে হচ্ছে পিঠের সাথেই চুল্লিতে কিছু একটা তন্দুরীর ন্যায় ভাজা হচ্ছে, কাঁধে জ্বলন্ত কয়লার একটা বিশাল বস্তা নিয়ে হাঁটছি! এই অবস্থায় মাথামুথা ঠিক রাখা দায়। হঠাৎ চরম ইচ্ছা হতে লাগলো টি-শার্টটা ঘড়াৎ করে খুলে ফেলি। নিচে স্যান্ডো আছে, সমস্যা না। আবার ভাবলাম, টি-শার্ট খুললে তো খালি স্যান্ডোটা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না। অবশ্য কঙ্কালের অবয়বটা বুঝা গেলেও যেতে পারে।

মনটা শান্ত হলো দেশের কথা চিন্তা করে। দেশেতো এর চাইতেও পাগলাগরম। সেখানে মানুষ নিশ্চই আর বস্ত্রহীন হয়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টের প্রস্তুতি নিচ্ছে না! এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে দেখলাম আমার মোটা মাথায়ও ভালো একটা জিনিষ খেললো। এই যে এই অসহ্য গরম লাগা, কম তাপমাত্রায়ও বস্ত্রহীন হয়ে পড়ার আকাংখা, এর পেছনে আসলে কারণ কী! কারণ আর কিছুই না, "ললনা"।

স্কুলে, গরমের দিনে ক্লাস করাটা বিরাট আজাবীয় মনে হতো। একেতো কো-এড ক্লাসে পোলাপাইনের ঘাপলাঘাপলি তারউপর নাই কোনো বাতাসদানযন্ত্র, আর বাইরে চলতো চৈত্রের চুড়ান্ত তাপদাহ। তো এমন একদিন ক্লাসে কী নিয়ে কথা হচ্ছে হঠাৎ এক ছেলে বলে উঠলো স্যার গরম লাগে কারণ মেয়েরা কথা বলে বেশি। স্যার বলেন, বেশি কথা বলার সাথে গরমের কী সম্পর্করে? পোলা কয়, স্যার মেয়েরা কথা কয় আর তাদের পেটের ভেতর থেকে ভুকভুক করে গরম বাতাস বের হতে থাকে। সেই গরম বাতাসই ক্লাস গরম করে ফেলে!

এখানকার মেয়েরা আরেক কাঠি সরেস। কথা বলার ইচ্ছার পাশাপাশি তাদের বস্ত্রের সংকুলানের তীব্রতাও প্রবল। একেতো গরমে চান্দি ফাটে তার উপর চোখের সামনে দিয়া ফুলচন্দন মার্কা স্বল্পবসনা ললনারা ইয়ে দুলিয়ে হেঁটে গেলে কার আর শীতল লাগে!

আশার কথা হলো, এই রিপোর্ট লেখার সময় আকাশ কালো করেছে কিঞ্চিৎ। মৃদুমন্দ সমীরণ না হলেও মোটামুটি দমকা স্টাইলেই হাওয়া দিচ্ছে। গাত্রউদোম করা এই গরমে আপাতত স্বস্তির খবর এটাই!

Friday, June 27, 2008

স্বপ্নযাত্রা

: হিথ্রো বাউন্ড!
: ইয়েস এন্ড মে আই রিকোয়েস্ট ফর এ উইন্ডোসীট প্লীজ!
: স্যরি স্যার, অল আর গন। হাউ এবাউট এ নাইস আইল ওয়ান ইনস্টেড!
: ইটস নট মাই চয়েস, বাট ইয়েস প্লীজ।
: এক্সট্রিমলী স্যরি, বাট ইউ আর...
: ইয়েস আই নো। আইল সীট ইজ ফাইন, থ্যাংক্স।

বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে পৌঁছুতে দেরী হয়ে যাওয়ায় চড়ে থাকা মেজাজটা আরেকটু চড়ে যায় প্লাস্টিক হাসি ঝুলানো গোলগাল মুখের তরুণীর কাঠখোট্টা আসন বিন্যাসের ধরণ ধরণ দেখে। জানালার ধারে বসে কয়েক পাত্তর ১৯৯২ সালের দ্রাক্ষারস গলায় চালান করে আয়েশ করে এলিয়ে থাকাটা বোধহয় হচ্ছেনা এবার! অনবরত পাশ দিয়ে কারও না কারও চলাফেরার কারণে সৃষ্ট বিরক্তি এড়াতে আইল সীটটা অপছন্দের খাতায় রয়ে গেছে সবসময়। কেউ হয়তো আকাশে ওঠার আধাঘন্টার মধ্যেই টয়লেটে যাবার বায়না ধরে বসে কিংবা পাশ দিয়ে একটু পরপর ঘটঘট করে একেকজন হোস্টেস বিপুল বিক্রমে হেঁটে যায়, কখনো তাদের সঙ্গে ঘরঘর শব্দ তুলে যায় মালগাড়ি। আর ফেরিওয়ালার মতো বিরক্তিকর একই শব্দের ঘ্যানঘ্যানি তো আছেই!

কাস্টমস, নিরাপত্তা সব পেরিয়ে বিরক্তিকর সোয়া ঘন্টার এক কপাল কুঁচকানো যাত্রা শেষে আবার কানেক্টিংএর ঝামেলা। সাড়ে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করাটাও বিরক্তিকর। বিশাল হিথ্রোর এমাথা-ওমাথা করা যায় বটে! হাতে বহনযোগ্য তেমন কিছু না থাকায় হেঁটে বেড়ানোটাই প্রাধান্য পেলো কোথাও সটান-নির্জীব বসে থাকার চেয়ে। আগে কখনো হিথ্রো দেখা হয়নি। গল্পই শোনা হয়েছে কেবল। বেশ লম্বা একটা জায়গা ধরে হাঁটতে গিয়ে মনে হলো এখানেই হয়তো চৌদ্দ বছর আগে ভাগ্নে জেদ ধরে দৌড় লাগিয়েছিলো এলোপাথারি। বাবা তার পিছুপিছু। দৌড় শেষ করে ক্লান্ত পুঁচকে ভাগ্নে আর পায়ে হেঁটে আসার শক্তি পায় নি। তাকে আসতে হয়েছে বাবার হাতে ঠেলা লাগেজ ট্রলীতে! দৃশ্যটা কল্পনায় আসতেই কপালের কুঁচকানো ভাবটা নিমিষে দূর হয়ে যায়। ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসির একটা রেখাও বোধহয় ফুটে ওঠে। নানা রকম ডিউটিফ্রী দোকানগুলোতে হাঁটতে হাঁটতে সামান্য ক্লান্তি অনুভূত হয়। সামনের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে একটা ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দেওয়া যাক তাহলে এবার।

ইংলিশরা কথা বলে পেটের ভেতর অর্ধেক রেখে, আইরিশরা আরও মারাত্বক! ভালো করে কান পেতে না শুনলে প্রাত্যহিক ইংরেজী ব্যবহার না করা যে কারও পক্ষেই ভাবোদ্ধার করা দুরূহ। ক্যাফেটেরিয়ার আইরিশ মেয়েটা দেখতে অপার্থিব হলেও কথা বলে গড মাস্ট বি ক্রেজী'র কালাহারীর সেই কালো মানুষটার মতো। যে কথা বললে মনে হয় পাখি কিচিরমিচির করছে, তার নিজস্ব ভাষায়! অপার্থিব সুন্দরী, পাখির কলতান- উপমাটা তাহলে নেহায়েতই মন্দ হয়নি। বরং একটা স্নিগ্ধতা ছড়ানো ব্যাপার আছে পুরো উপমায়। কফির স্বাদও খারাপ না। দশে সাড়ে ছয় দেয়া যায়। ফার্স্ট ডিভিশন মার্ক। এখনকার জিপিএ সিস্টেমে কতো হয় কে জানে!

কফিতে তৃতীয় দফা চুমুক দিতে গিয়ে চড়কীর মতো ঘুরতে থাকা চোখে যে জিনিষটা আটকে যায় সেটা সুরুৎ করে নিয়ে যায় বহু বছর আগের এক ঘটনায়। সুমনা, ডেনিম জিন্স আর কালো ফতুয়াতে । তখন সতেরোতে থাকা সুমনার সঙ্গে টক-ঝাল-মিস্টি এক সম্পর্ক। সময়ের স্রোতে সম্পর্কের আচার থেকে টক আর ঝাল জিনিষগুলো ঝরে যায়। তবে মিষ্ট ভাবটা বেশিদিন টিকেনি। সেখানে সামান্য পরিমান তেঁতো যোগ হয়ে যায় কী করে যেনো। হয়তো দূরত্ব, হয়তো অন্য কিছুর কারণে! মিষ্ট-তেঁতো সম্পর্কটা ধ্বসে পড়েছিলো আধাযুগ পরে। পুরো নিশ্চিহ্ন হয়ে হয়তো যায় নি, হয়তো ধ্বংসাবশেষ কিছুটা রয়ে গিয়েছিলো, দাঁড়িয়ে ছিলো ধুঁকে ধুঁকে। সম্পর্কের ধ্বংসাবশেষে যেনো কখনো মোলায়েম হাতের ছোঁয়া গভীর ক্ষত তৈরী করতে না পারে, সেজন্য স্মৃতিকোটরের সেই দরজাগুলো চিরতরে সিলগালা করে দেয়া হয়েছিলো। আর খোলা হয়নি, এতোগুলো বছরেও, দেখা হয়নি কতোটা সৃতির ধূলা পড়লো সেই ভগ্নাংশের ওপর! কতোশত ইচ্ছা ছিলো, স্বপ্ন ছিলো, আকাংখা ছিলো। আটলান্টিকের বিশাল জলরাশি তার সবকিছুই নিয়ে নিয়েছে নিজের বুকে। একটু ক্ষণের দেখা হওয়ার আকুতি ছিলো। নাটকীয়ভাবে দেখা হওয়া বিমান যাত্রায় একসঙ্গে বাকী পথ পাড়ি দেবার কথা ছিলো, ফেরার কথা ছিলো একই সঙ্গে। হাত ধরে খানিকটা সময় চুপচাপ বসে থাকা হয়নি সমস্ত কোলাহল উপেক্ষা করে। কাঁধে মাথা রেখে চুপটি করে ঝিম মেরে থাকার কথা ছিলো কতোবার। কিছুই হয়নি। সময় চলে গেছে সুমনাকে সঙ্গে করে। পথের সেই বাঁকে, ফিরে এসে যেখানে সুমনাকে পাবার কথা ছিলো, মাঝে মাঝেই দূর থেকে চোখ বুলানো হয়। বাঁকটা এখনো রয়ে গেছে সেরকম। সময়ের মরচে ধরেনি আদৌ। কখনো সখনো মৃদু বাতাসে কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে যায় পথের সে বাঁক ধরে। শুধু সময়টাকে বাহন করে সেই বাঁকে আর উড়ে ফেরা হয়না কারোই, কখনোই!

হ্যালুসিনেশন! এই সময়ে, এখানে সুমনার থাকার কথা না। আর যাকে গত বহু বছরে একবারও দেখা হয়নি, তাকে এক পলকে দেখে একবারেই চিনে ফেলাটা কিছুটা অসম্ভবই। অতএব সমীকরণ মেলানো হলো, "সুমনা এই মুহূর্তে এখানে নেই!"

কফি ঠান্ডা হয়ে জমে গেছে সেই কখন। ঠান্ডা কফি খেতেও অবশ্য আলাদা একটা থ্রীল আছে। আইরিশ তরুণীর কলতান আরেকবার শোনার আগে বরং এই থ্রীলটাই গলাধঃকরণ হোক আগে।

অল প্যাসেঞ্জার অফ বিএ-জিরো ওয়ান ফোর ফাইভ, টু ডাক্কা আর রিকোয়েস্টেড টু প্রোসীড... ৪ নাম্বার টার্মিনালের সবগুলো স্পীকার কাঁপানো ঘোষণায় আরেকদফা কপাল কুঁচকানো আগাপাশতলা চেকিং শেষে মাথা ধরানো হাউকাউমুখর কক্ষে প্রায় দশ ঘন্টা ব্যাপী ভ্রমনের মানসিক প্রস্তুতি প্রায় নাগাল ছেড়ে বেরিয়ে যায়, এমন অবস্থা। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় ঠাঁই হলো একদম কোণার দিকের একটা আসনে। ৭৭৭ বোয়িংএ উঠার নাটক মঞ্চায়নের পর্দা উঠতে এখনো বুঝি অনেক দেরী। কানে উপলকে তার "আমি চাই তোমাতে হারাতে" সহ গুঁজে দিয়ে জানালার বাইরে বিশাল এয়ারক্রাফট পরিদর্শনটাই এই মুহূর্তে বুদ্ধিমানের কাজ! আপেক্ষমান সেই কক্ষে মানুষ আসছে-বসছে-দাঁড়াচ্ছে, বসা কেউ দাঁড়াচ্ছে, দাঁড়ানো কেউ হাঁটছে, সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে, হাঁটুক না যার যতো খুশী! কপালটা একটু একটু করে আরও বেশি কুঁচকে যাচ্ছে। কক্ষের আড়াআড়ি একটা আসন থেকে কেউ উঠে সামনে দিয়ে পায়চারীর মতো করে হেঁটে গেলো বারকয়েক। তারপর হঠাৎ থেমে, খানিক ইতস্ততঃ হয়ে জিজ্ঞেস করে, "আপনি, মানে তুমি সম্রাট...!"
সেই পরিচিত কণ্ঠ, কণ্ঠে সেই পরিচিত ঝংকার। দৃষ্টিসীমার ঘুচানো ব্যবধানে সৃষ্ট অস্পষ্টত্ব কাটিয়ে ওঠার পর বুঝা যায়, হ্যালুসিনেশন নয়, এ যে সুমনাই। কতগুলো বছর পর! কপালের ভাজগুলো মুছে যেতে থাকে একএক করে। প্রসন্নতা ফুটে উঠতে থাকে অবয়বে। এতোদিনের বদ্ধকুঠরীর দরজাগুলো একে একে সব সশব্দে খুলে যেতে থাকে যেনো আজ, এই জুনের পড়ন্ত বিকেলে।

: কেমন আছো সু! অনেক শুভেচ্ছা আজকের দিনে তোমাকে।
: মনে রেখেছো তাহলে...।

আরোহন শুরু হয়ে গেছে ততোক্ষণে। এক স্বপ্ন যাত্রার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সম্রাট ভাবে এই স্বপ্নটা সত্যি হলে কী এমন ক্ষতি হয় জগতের!

Monday, June 23, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০৭

মন করুণ পর্ব

ধুসর গোধূলি'র মনটা খারাপ করেছে। তা সে যেন-তেন খারাপ না। একেবারে দশাসই রকমের খারাপ। চিনচিনে খারাপ লাগাটা নেই তবে ভোঁতা ভ্যাপসা ভাব আছে। পুরো শূন্যতা না থাজকেও একটু খালি খালি লাগা আছে। আমার এই একটুর জন্য প্রেমে পড়া হলোনা- মন করুণের আপাতঃ কারণ হিসেবে এটাই দাঁড় করানো গেছে!

ট্রেনে উঠে সুবিধামতো জায়গার আকালে কোথায় বসা যায় এই নিয়ে ভেবে যখন এগুচ্ছিলাম তখনই চারজনা সীটের তিনটাই খালি পেয়ে ধুপুশ করে বসে পড়লাম। যেখানে বসলাম সেটা মোটেও আমার পছন্দের জায়গা না। উল্টোদিকে গাড়ি চললে কেমন উল্টা উল্টা লাগে দুনিয়া। নাকমুখ কুঁচকে সামনের সহযাত্রীর দিক দিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিতেই দেখলাম একজোড়া চোখ বেশ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আমাকে। আমি তাকালাম সে চোখে। ভয়ানক সুন্দর ফটিকা চোখ। মার্বেলের মতো স্বচ্ছ। একটু জুম আউট করলাম আমার দৃষ্টি। মুখায়বটাও দারুণ মিষ্টি। আরেকটু জুম আউট করলাম। নাহ্, এ পর্যায়ের দর্শনাবস্তুর কথা না বলাই ভালো। জুমইন করলাম। দৃষ্টি ডানে বামে ঘুরে ফোকাস মুখায়বে। নাকের ডগাটা একটু টেপ খাওয়া, একটু খাদ কিন্তু কেমন অদ্ভূত মিষ্টতা ছড়ানো সারাটা মুখ জুড়েই। দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম অন্যদিকে।

দৃষ্টি রেঞ্জের ভেতরে থাকায় বুঝতে পারছিলাম তখন সরিয়ে নেয়া চোখ জোড়া আবার আমার মুখের দিকে ফোকাসিত। একটু পর লেন্স ডানে ঘুরিয়ে জানালায় ফোকাস করার সময় চোখে চোখ আটকে গেলো। গোল গোল চোখ, সরে না। একটু পর নামিয়ে নিলো, সরিয়ে নিলাম আমিও। আবার, এবং আবারও, তারপর আবার! এবার আমি সরাবার আগে ভদ্রতাসুলভ মুখ বাঁকালাম।

বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। ওপরের জানালা কাত করা। ঠান্ডা একটা বাতাস ঢুকছে তাই। খুব সম্ভবত শীত লাগছে। জানালাটা লাগাতে চাইছে, পারছে না। কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়াই সাহায্য প্রার্থনা করলো। আমি আস্তে করে উঠে লাগিয়ে দিলাম। সুন্দর-মিষ্টি মুখ ফুটে "আন্তরিক ধন্যবাদ" বের হলো। আমি হাসি দিয়ে ভদ্রতা সূচক উত্তর দিলাম। আবার সেই নীরবতা, দৃষ্টি ক্যামেরার আনুভূমিক সঞ্চারণ এবং সংযোগ! যে কয়বার আটকে গেলো, আমার দেখানো পথ অনুসরণ করে মুখ বাঁকা করে ভদ্রতা করতে চাইলো। ট্রেন যাবে অনেকটা পথ। আমি নেমে যাবো পথে। হিসাব কষছিলাম কোথায় গিয়ে শেষ হবে সুন্দর মুখের যাত্রা।

এক স্টেশন বাকি থাকতে কোলন শহরের নামাঙ্কিত কালো রঙের ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে তাতে তাবাক ভরে পাকিয়ে সিগারেট বানানোর ফাঁকে আমার দিকে তাকিয়ে নিলো। কী জানি ছিলো সেই তাকানোতে! সে নেমে যাবে, কেমন লাগছিলো! কিন্তু সে নামলো না। আমার স্টেশনের অ্যানাউন্স হতেই উঠে চলে গেলো দরজার কাছে। এখন নামতে গেলে যদি ভাবে তাকে ফলো করছি! শালার কপাল...

উঠে দরজার কাছে যেতে আবারও চোখে চোখ পড়লো। আবারও সেই হার্টএ্যাটাক করানো মোনালিসা হাসি। নেমে গেলো আগে, পিছনে আমি ও কয়েকজন। ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে গেলাম। সামনে গিয়ে ঘুরে আবার সে পেছনে এলো। কারও কি নিতে আসার কথা? আসেনি! আমার বাঙ্গুমন দোটানায় পড়ে গেলো। থামবো কি থামবো না! পা চলছে। মাথায় অনেক হিসাব, একের পর এক সশব্দে জট পাকাচ্ছে। চোখ সোজা, পথের দিকে। প্যান্টের পকেটে হাত, স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্লবোরো লাইটের প্যাকেট তুলে নিলো লাইটার সহ। আরেক হাত টুক করে একটা আগরবাতি বের করে সেটা জ্বালায়িত করলো। অবশেষে পা থামলো, থামলাম আমিও। কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দূর টেনে নিয়ে এসেছে হতচ্ছাড়া পদযুগল। এখনতো আর ফেরা যায় না!

Friday, June 06, 2008

যে গল্পটা লেখা হতে পারতো অন্যভাবে

গ্রীষ্ম, ২০০৪
শনিবার বিকেল, এথেন্সের কোনো একটা জায়গা।


বাতাসটা ঝিরঝিরে অবস্থায় আর নেই। হঠাৎ হঠাৎ ধপ করে এসে গায়ে ধাক্কা মেরে পেছন দিকে চলে যাচ্ছে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের এক মানব সন্তানের কালো চশমায় চোখ ঢেকে রৌদ্রস্নানে বসে থাকা এরিয়েলে'র ঠিক যুতসই লাগছে বলে মনে হচ্ছে না। সে তার লাঠিয়াল বাহিনীকে একটু পরপরই খুঁচিয়ে যাবার জন্য পাঠাচ্ছে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মানব সন্তান সেদিকে নির্বিকার। বাঁকা ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে রেখে হাতের ট্রপিক্যাল জ্যুসের গেলাসে একটু পরপর চুমুক দিয়ে যাচ্ছে।

খুব সন্তর্পণে, বালুর সৈকতে পা ডুবিয়ে উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের যুবকটির খুব কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার চোখ বোজা। কিছু একটা ভাবছে নির্ঘাৎ। চোখের বল নড়ছে অনবরত, ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা হাসিটার ও রকম পরিবর্তন হচ্ছে। রোদের আঁচে গাল গুলোয় লালচে আভা ধরে এসেছে। বোতাম খোলা হাফস্লীভ শার্টের পতপত শব্দের সঙ্গে ভেসে আসে কোরাসে'র ভোঁতা সুবাস। যুবকটির পেছন থেকে ধীরে ধীরে তার ডান দিক ধরে দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ রেখে, সামনে দিয়ে ঘুরে এসে তার এলানো শরীরের সঙ্গে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণ তৈরী করে পিছিয়ে আসা যাক, এবারও ধীরে ধীরে।

: কী ভাবছে এই যুবক!
: হোয়াট-এভার!

ফেব্রুয়ারীর এক সকাল, কয়েক বছর আগে-
সিডনী, অস্ট্রেলিয়া।


শনিবার। সাধারণত শুক্রবার রাতে সিনেমা টিনেমা দেখে দেরী করে ঘুমানোর ফলে শনিবার দিনটা শুরু হয় একটু বেলা করেই। জুলিয়া রবার্টস প্রিয় নায়িকা। তার সঙ্গে "তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম" গানের শ্যুটিং সবে শুরু হয়েছে, জুলিয়া ঢাকার জামদানী শাড়ি পরে, পাটক্ষেত মাড়িয়ে দৌড়ে যেই না আমার বুকে এসে ঝপাৎ করে পড়বে অমনি নোকিয়া ৫১১০ একঘেঁয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার মতো ডাকা শুরু করলো। আর কী! জুলিয়াকে ফেলে ৫১১০কেই তুলে নিতে হলো বাধ্য হয়ে। ঘুমে ভেজা গলায় কথাও শুরু করতে হলো-

: হ্যালো...
: নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ। আমি সিজারের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি।

এবারে ঘুম একলাফে বিরাট কাঁচের জানালা দিয়ে পালিয়েছে। ধরমড় করে উঠে বিছানায় বসে-

: জ্বি, বলছি। বলো তোমার জন্য কী করতে পারি।
: উই হ্যাভ এ সিচুয়েশন...!
: দয়াকরে আমার কাছে ব্যাখ্যা করো-

ওপাশ থেকে ঘটঘট হাসি ভেসে আসে। ফাবিয়ান রিবেইরো, আমার ইমিডিয়েট বস।

: ঝটকা খেয়ে গেলা মাইট?
: তোমাকে ুদি ফাবস্। বলো কোন আনন্দে আমার ঘুমের বারোটা বাজালা?
: তুমি কি আজকে কাজ করতে পারবা, এইটা একটা প্লীজ!
: আজকে তো আমার কাজ করার কথা না। তাছাড়া আমি তো ঘুমাচ্ছি এখনো। কিছু মনে করো না। সম্ভব না বাডি, দুঃখিত।
: হ্যাঁ, অপ্রত্যাশিত ভাবেই তোমাকে ডাকতে হচ্ছে। তুমি দরকায় হয় ঘন্টাখানেক পরেই আসো, ব্যাপার না।
: দুইটার আগে পারবো না মাইট।
: ও.কে তাহলে, দুইটায় ই সই। অনেক ধন্যবাদ বাডি। তুমি আমার ুটকি বাঁচিয়েছ। দেখা হচ্ছে তাহলে।
: ইয়াপ...॥

- উইকএণ্ড, দুপুরবেলা কাজ করলে টিপস পাওয়া যায় অনেক। খুব সম্ভবত ফুল অকুপেন্সী। ঘন্টার টাকাও বেশি, টিপসের টাকায় তেলের খরচ উঠে যাবে। ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছেড়ে তৈরী হয়ে সবেধন নীলমনি ফোর্ড ফ্যালকন ৮২তে চড়ে বসলো সিজার।

ফোর্ড ফ্যালকন, সিজারের প্রথম গাড়ি। এক হাজার ডলারে কেনা। চারটা চাকা ছাড়া যার উল্লেখযোগ্য আর কিছুই নেই। ও হ্যাঁ, আছে তো। খুব জোরে বৃষ্টি হলে ছাদ চুঁইয়ে গীয়ার বক্সের উপরে পানি পড়ে, সে পানির ছিঁটায় সীট থাকে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে। ক্যাসেট তো দূরের কথা রেডিওই ঠিকমতো বাজে না, বাজলেও পোঁপোঁ- ফোঁসফোঁস আওয়াজের জন্য কিছুই শোনা যায় না। স্পীডক্লের লাইট নেই- অন্ধকারে তাই দেখার উপায় নেই কতো দ্রুত যাচ্ছে। সেসময় আন্দাজ আপনা আপনা, আন্দাজই ভরসা। হেডলাইট একটা জ্বলে, আরেকটা জ্বলে না। তবে হাইবীম দিলে দুইটাই জ্বলে কিন্তু তখন রাস্তার আর কিছু দেখা যায় না, সামনের গাছপালার উপরের অংশের সামান্য জায়গা ছুঁয়ে আলো চলে যায় আকাশের পানে। (কে জানে, এই গাড়ি যে বানিয়েছে তার হয়তো নভোচারী হওয়ার শখ ছিলো কিংবা নিদেনপক্ষে নাসায় কাজ করার!) প্রথম যেদিন গাড়ি নিয়ে কাজে গিয়েছিলো সিজার, ম্যানেজার (এবং বন্ধু) মাইকেল হিউস ইঞ্জিনের অবস্থা পরখ করার জন্য এক্সেলেটরে বিশাল এক চাপ দিয়ে বের হয়ে তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেই পেছন ফিরেছে, অমনি "জিজাস ক্রাইস্ট" বলে চিৎকার করে উঠেছে। পেছনের রাস্তায় বিশাল একটা জায়গা দখল করে রেখেছে তখন কালো ধোঁয়া!

এই হলো তার ফোর্ড ফ্যালকন। ৮২ মডেল। লাল রঙা বিশাল বপু একটা গাড়ি। একে নিয়েই রওনা দিলো প্যারামাটা রোড ধরে।

হোটেলের স্টাফ চেঞ্জিং রুমে পৌঁছতেই তাকে পেয়ে ফাবস্ দুঃখ প্রকাশ করলো ঘুম থেকে জাগানোর ফলে। সিজারও নো ওয়ারিজ বলে তৈরী হয়ে চেঞ্জিং রুম থেকে বের হয়ে করিডোরে পা ফেললো। লবিতে ঢুকার দরোজার পিতলের হাতলে হাত রেখে যখন সিজার ঢুকছে, সে তখনো জানে না আজকে তার জন্য কী এক অদ্ভুত-আনন্দদায়ক-বেদনাতুর সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে!

টীমমেট এন্থনি পিরী, জ্যাকি চয়, টীমলিডার ডেভিড জেনকিন্স, বেন মেসন- সবাই দৌঁড়ের ওপর। স্যাম জানালো হানড্রেড এণ্ড ফাইভ পার্সেন্ট অকুপেন্সী। সিজারেরও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো কোনো কিছু বুঝার আগেই। গেস্টকে গ্রীট করা, চেক ইন করা এবং সুযোগ বুঝে গেস্টকে ওপরে নিয়ে তার রুমের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেয়া- এই করতে করতে ভয়ানক ব্যস্ততার ঘন্টাখানেক সময় হুঁশ করে চলে গেলো। তখনই ঘটলো ঘটনাটা।

জলবিয়োগ শেষে শিষ বাজিয়ে লবিতে ঢুকার মুহূর্তেই সুন্দরী স্যাম সিজারকে ডেকে বললো, "যদি কিছু মনে না করো, তাহলে এই গেস্টত্রয়কে তাদের রুমে নিয়ে যাবা? এইটা একটা প্লীজ!"

তাদের দিকে একবার তাকিয়ে সিজার হাসি মুখেই রাজী হয়ে যায়। দোতলার দুশ ছত্রিশ নাম্বার রুমে স্ট্রাইপ কী পাঞ্চ করে, ঘরের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেয়। কীভাবে সেফ কাজ করে, কোথায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, কীভাবে সেটা চালাতে হয়, উইনিক ভ্যাকুয়্যাম সিসটেমে টয়লেটে একটু শব্দ হয় ফ্ল্যাশ করলে, হার্টের রোগী কেউ থেকে থাকলে যেনো ভয় না পায়... ইত্যাদি ইত্যাদি।

দুশ ছত্রিশের স্পেশালিটি হলো, এর সাথে লাগোয়া একটা বড়, খোলা বারান্দা। সেখানে সূর্যস্নান করার জন্য রাখা আছে কাঠের কয়েকটা চেয়ার। সেকথা বলতে বলতে সিজার তিনজনের একেকজনের মুখের দিকে তাকায়। দুজনের বয়স পঞ্চাশ পেরোনো বলে ধারণা হয়। এদের একজন খুব কথাপাগল। সেই তখন থেকেই নানা কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে সিজারকে। এলিভেটরে, করিডোরে, এমনকি রুমে ঢুকেও। নেমপ্লেট থেকে নাম জেনে নিয়ে সরাসরি নাম ধরে সম্বোধন করছে। দ্বিতীয়জনও কথা বলার দিক দিয়ে প্রথমজনের প্রায় কাছাকাছি। তৃতীয়জন আপাতত ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখছে, একদমই কোনো শব্দটি ছাড়া।

মুখে একগাল হাসি এনে অ্যান নিজের পরিচয় দিলো। হাত মেলালো। তার ননদ মারিয়া'র জন্মদিন উপলক্ষ্যে সিডনী বেড়াতে এসেছে একদিনের জন্য। মারিয়া'র দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সিজার, জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো হাসিমুখে। অ্যান বললো, তুমি খুব ভালো ছেলে সিজার, এসো আমার মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। সিজারের এতোক্ষণ মনে হচ্ছিলো সঙ্গের প্রীতিজিনটা সদৃশ মেয়েটি হয়তো কথা বলেনা কিংবা বাদামী চামড়ার সিজারকে অবহেলা করতে চাচ্ছে আরদশজন অজিললনার মতো। অ্যানের আমন্ত্রণে একটু ইতস্ততঃ বোধ করে বললো, খুব সম্ভবত তোমার মেয়ে একটু একা থাকতে চাইছে। আর আমাকেও তাড়াতাড়ি নিচে ফিরতে হবে। আমি আশা করছি তোমাদের অবস্থান আনন্দময় হবে আমাদের সঙ্গে! সিজার মুখে এক চিলতে প্লাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে দুশ ছত্রিশ নাম্বার ভরে ওঠে রিনরিন শব্দে।

: আমি আমেন্ডা!

সিজারের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া একটা হলদেটে হাত, মুখে ঝুলানো বুদ্ধিদীপ্ত এক হাসি।

: আমি কথা একটু কম বলি এমনিতেই। কিছু মনে করোনা, প্লীজ! তাছাড়া তুমি কথা বলো খুব সুন্দর করে, তোমার কথাই শুনছিলাম তাই মন দিয়ে।

: যাক, কথা বললে শেষ পর্যন্ত। নাহলে হয়তো এই ধারণা নিয়েই আমি চলে যেতাম যে তুমি হয়তো কথা বলোনা!

হেসে উঠলো সবাই।

: আমার মেয়েটা সুন্দর না অনেক, সিজার?
আমেন্ডা মা-আ-ম বলে মায়ের দিকে কপট রাগের ভঙিতে তাকায়।
: তাতে কোনো, সন্দেহ নেই। আমি মনে করেছিলাম আকাশ থেকে নেমে আসা কোননো নিম্ফ!
দাঁত বের করে সিজার জবাব দেয়।
অ্যান হাসতে হাসতে সিজারের বাহুতে হালকা চাপড় দেয়, "ইউ আর সো নটি!" মারিয়া যোগ করে, "আই শ্যুড রাদার সে, স্মার্ট ওয়ান"।

এবার বিদায় নিয়ে চলে আসে সিজার। সন্ধ্যের দিকে আবার ব্যস্ততা বাড়ে। অন্য অনেক ঘটনার মতো দুশ ছত্রিশ নাম্বারের কথাও ভুলে যায় সিজার।

একই দিন, সন্ধ্যাবেলা
হোটেলের লবি


ব্যস্ততা কমলে ডেভিড কাছে এসে বলে তোমাকে ঐ মেয়েটা খুঁজে গেছে! সিজার অবাক হয়, কোন মেয়েটা?

: ঐযে, যাকে ওপরে নিয়ে গেলে!

সিজার বুঝতে পারে ডেভিড মজা করছে তার সঙ্গে। শুধু ডেভিড না। তার টীমমেটদের প্রায় সবাই খুব মজা করে ওর সঙ্গে। এমন কি ম্যানেজাররাও যোগ দেয় তাতে অনেকসময়। ২১ বছর বয়সেও স্টিল-ভার্জিন, শুকর না খাওয়া, মদ না খাওয়া এসব ব্যাপারগুলো তাদের কাছে দারুণ ইন্টারেস্টিং। প্রথম ডিকে হেসে উড়িয়ে দিলেও আস্তে আস্তে কালচারাল পার্থক্যটা বুঝাতে পেরেছে সে টীমমেটদের। এখন বেশ আগ্রহ নিয়েই তারা জানতে চায় অনেক কিছু। প্রথমদিকের মতো খোঁচামারা মজা আর করেনা কেউ। কিন্তু যে ডেভিড নিজেকে সিজারের বড়ভাই বলে পরিচয় দেয়, সে কেনো আজ এরকম মজা করছে। সিজার বেশ ভালো করেই জানে তাকে কেউ খোঁজেনি!

জ্যাকি চয় ছিলো কাছে। ডেভিড তাকে ডেকে আনলো। জ্যাকিও সায় দিলো কথায়। এবার সিজার বুঝতে পারে, ঘটনাটা পুরোটাই সাজানো। সেও মজা করতে থাকে তাদের সাথে...। এর মধ্যে বার থেকে লবি হয়ে বরিয়ে যাওয়ার সময় চারজনের একটা গ্রুপ থেকে আধামাতাল একটা মেয়ে হঠাৎ করে সিজারের হাতে এক গোছা গ্যাস বেলুন ধরিয়ে দিয়ে বলে এগুলা তোমার জন্য, রেখে দাও! বেলুনগুলো উড়িয়ে না দিয়ে, ঘরে ফেরার সময় সিজার সেগুলো গাড়ির পেছনে বেঁধে নিয়ে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে।

হোটেলটা দাঁড়ানো সিডনী হার্বারের এক পরিত্যাক্ত পীয়ারে। লবির এক পাশে আট ফুট বাই আট ফুট একটা গ্লাস ফ্লোর আছে যার মধ্য দিয়ে তাকালে নিচে নানারকম মাছের ঝাঁক দেখা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সিজার। রিসেপশন ডেস্কে গ্রেস একা, কোনো কাজ নেই। খুব সম্ভবত মেইল চেক করছে। তার পাশেই ডেভিড কথা বলছে ম্যানেজার ট্রেভরের সঙ্গে, ট্রেভর অবশ্য রিভলবীন চেয়ারে একবার ডানে আরেকবার বামে ঘুরছে। লবিবার-এ জ্যাঁ আর জেইসনের মুখ হা হয়ে গেছে ড্রিংক সার্ভ করতে করতে। এমন সময় সিজার তার কাঁধে কারও স্পর্শ অনুভব করলো। পেছন থেকে কেউ হয়তো তাকে চমকে দেবার জন্য এমনটা করে থাকবে। ও ঘুরে মারাত্বক একটা কার্সিং ওয়ার্ড বলতে গিয়েও থেমে গেলো।

সিজার অস্বস্তি মেশানো হাসি দিয়ে বলে,

: আরে আমেন্ডা, তুমি! তোমার মা-ফুফু কোথায়!
: ঐযে বারে, ড্রিংক করছে।
: তুমি করোনা?
: নাহ্, জানো আমরা নৌকা করে সিডনী হার্বারে সারাটা সন্ধ্যে ঘুরেছি।
: বাহ্, তোমরা নিশ্চই অনেক মজা করেছো তাহলে।
: হুমম, তা করেছি। আমি তোমাকে খুঁজেছিলাম বাইরে যাওয়ার আগে।
: তাই নাকি!
: কেনো, বলেনি কেউ!
: হ্যাঁ বলেছে। কিন্তু বিশ্বাস করিনি।
: আমি আসলেই তোমাকে খুঁজেছি সিজার...

- আমেন্ডা এমনিতেই আস্তে কথা বলে। এই কথাটা সে অনেকটা ফিসফিস করে কানের কাছে এসে বললো। মনে হলো, ও কাঁপছে। এই কাঁপুনীর সঙ্গে সিজারের পরিচয় আছে। ও চারদিকে তাকাতে গিয়ে দেখে ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে কয়েকজোড়া চোখ খুব উৎসাহ নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সিজারের আরও অস্বস্তি হতে শুরু করলো। ও নিজেকে একটু সরিয়ে নিয়ে বললো,

: জানো, তোমার জন্য আমার একটা উপহার আছে।
আমেন্ডা এবার খুশীতে ঝলমলিয়ে উঠে হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, "সত্যি!! দাও তাহলে।"

সিজার লক্ষ্য করলো আমেন্ডার হাত কাঁপছে। তার নিজেরও শরীর কাঁপছে কোনো এক অজানা কারণে। মনে হচ্ছে কান দিয়ে সমানে ধোঁয়া বের হচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

: তুমি রুমে যাও, আমি নিয়ে আসছি।
: তুমি আসবে তো!
: হ্যাঁ, আমার আরেকটু পরেই ছুটি হবে, আমি বেরিয়ে যাবার আগে তোমার রুমে নক করে উপহারটা দিয়ে যাবো।
: ঠিক আছে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষ করবো!

এলিভেটর ধরে আমেন্ডা চলে গেলে। যারা এতোক্ষণ তাকিয়ে ছিলো, তাদের দিকে হাত নেড়ে "কী ব্যাপার, কী দেখছো!" ভঙি করে সেখান থেকে সরে যায় সিজার।

রাত এগারোটা
হোটেলের করিডোর


সিজার আস্তে করে নক করে দুশ ছত্রিশের দরোজায়। ভেতর থেকে কারও ছুটে আসার ধুপধাপ আওয়াজ পায়। দরজা খোলা আমেন্ডাই। খুলেই হাত বাড়িয়ে ধরে, আমার উপহার কই?
পেছন থেকে অন্যহাত ঘুরিয়ে এনে বেলুনের তোড়াটা আমেন্ডার সামনে ধরে। আমেন্ডা অনেক খুশী হয়। ভেতর থেকে অ্যান ও মারিয়া হাত নাড়ায়। হাউজকিপিংএর বুড়ো ডানিয়েল অতিরিক্ত বিছানা বানিয়ে দিচ্ছে। এর পরের কয়েক মুহূর্ত কেটে যায় নিঃশব্দে, দরজার চৌকাঠের সীমানায় দাঁড়ানো দুজনের। সিজার বরফ ভাঙে।

: কী করবে এখন, ঘুমাবে?
: নাহ্, খুব সম্ভবত টিভি দেখবো। ঘুম আসবে না। তুমি কী করবে!
: আমি এখন বাড়ি যাবো, তারপর জানি না।

আবারও চুপচাপ। আমেন্ডা পায়ের নখ দিয়ে কার্পেট খুঁটছে, সেটা সিজারের দৃষ্টি এড়ায় না।

: তুমি কি বাইরে যেতে চাও?
: তুমি নিয়ে যাবে আমাকে?
: তুমি যেতে চাইলে, অবশ্যই!

আমেন্ডা মনেহয় এমন একটা কথার জন্যই অপেক্ষা করছিলো এতোক্ষণ।

: তুমি একটু দাঁড়াও, আমি আমার জ্যাকেটটা নিয়ে আসি।
এক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে জ্যাকেট নিয়ে এলো হাঁপাতে হাঁপাতে।
: চলো।
: ঠিকআছে। তুমি মেইন লিফট ধরে লবিতে যাও। আমি স্টাফরুমে চেঞ্জ করে আসছি। প্রধান ফটকের সামনে থেকে তোমাকে ডেকে নেবো!
: আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো...

ফাস্টফোরোয়ার্ডের মতো চেঞ্জ করতে করতে সিজার চিন্তা করার চেষ্টা করলো কী হতে যাচ্ছে। এর আগে তো কখনোই এমন হয় নি। ও কি "ডেট" এ যাচ্ছে! সেটা কী করে সম্ভব! উঁহু, এটা হতে পারে না। সামথিং মাস্ট বি রং।

প্রধান ফটকের সামনে এসে সিকিউরিটি অ্যালান কে সিজার অনুরোধ করলো লবিতে দাঁড়ানো মেয়েটিকে তার কথা বলতে। অ্যালান থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলো, সিজার নিশ্চিত কীনা। কারণ কোনো গেস্টকে উত্যাক্ত করার অপরাধে তার নিজের চাকরিও চলে যেতে পারে। সিজার অ্যালানকে আশ্বস্ত করলো, জাস্ট গো এন্ড টেল হার দ্যট আই এম হিয়ার!

অ্যালান কে হা করিয়ে রেখে আমেন্ডা হাসি মুখে বেরিয়ে এলো। তারা হাঁটতে শুরু করলো হার্বার সাইড ধরে। ব্রীজ পেরিয়ে, হায়াত হোটেলের সামনের কাঠের জায়গাটুকু পেরিয়ে সার্কুলার কী, ফেরী ওয়ার্ফ পেরিয়ে যায় তারা একে একে। সিজার অবাক হয়, অস্ট্রেলিয়ান হয়েও মদ আর সিগারেটের প্রতি মারাত্বক অনীহা আমেন্ডার। আরও আশ্চর্য হয়ে গেলো যখন বললো, "সিজার আমি তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি।"

সিজার তখন বিষম খেয়ে বোকার মতো প্রশ্ন করে বসে, "কী!! আমি ই কেনো!"
আমেন্ডা হাসে, "সেটা তো বলতে পারবো না। শুধু জানি আমার অনুভূতি বলছে যে আমি তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি!"
সিজার এবার বলে,"হ্যাঁ আমিও তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি আমেন্ডা"
কথাটা বলে সিজার বুঝতে পারে না সে সত্যি বললো না মিথ্যে। তার কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না এখন। মাথা পুরো ফাঁকা মনে হচ্ছে। কিছুই নেই, সব ফকফকা।

আমেন্ডা সিজারের একটা হাত তুলে নিলো তার হাতে। খুব সন্তর্পণে সেই হাতটা নিজের বুকে চেপে ধরলো। সিজার আমেন্ডার বুকের উষ্ণতা টের পেলো, আঙুলের মাথায় উঁচু মাংসপিন্ডের অস্তিত্ব টের পেলো সে। তার সারা শরীর ঝাঁকা দিয়ে গেলো। সিজারের আর কোনো বোধশক্তিই অবশিষ্ট নেই। যেকোনো মুহূর্তে ঠাশ করে পরে যাবে বুঝি! এ কোন যন্ত্রণা হলো। কী বলছে তা সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে না।


রাত বারোটা নাগাদ,
অপেরা হাউজ, সিডনী হার্বার


অপেরা হাউজের একদম উপরের ব্যালকনিতে রেলিং ঘেঁষে দুজন দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। হঠাৎ আমেন্ডা সিজারের ধরে থাকা হাতটা আস্তে করে ছেড়ে দেয়। সিজার বুঝতে পারেনা। সিজার তার হাত ধরতে গেলে আমেন্ডা বলে, "আমি ঠিক আছি। এভাবেই ভালো লাগছে।"
সিজার বুঝতে পারে কোনো গোলমাল হয়েছে। আস্তে আস্তে তার স্বাভাবিক সম্বিত ফিরে আসতে শুরু করে। কিছুক্ষণ আগের কথোপকথন মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। নাহ্, খুব খারাপ কিছু বলেছে বলে তো মনে পড়ছে না তার! এভাবেই কথা চলতে থাকে কিছুক্ষণ। আমেন্ডাই হঠাৎ বলে ওঠে, "হোটেলে ফেরা প্রয়োজন।"
সিজার অবাক হয়, একটু আগেও বলছিলো সারারাত বসে কাটিয়ে দেবে হার্বারে, সিজারের সঙ্গে। অথচ এখন ফিরে যেতে চাইছে। সিজার আবারও জিজ্ঞেস করে, সব ঠিক আছে কীনা!
আমেন্ডা হেসে মাথা নাড়ায়! সিজারের সন্দেহ দূর হয় না।

রাত, বারোটা চল্লিশ
ওয়লশ বে, পিয়ার ওয়ান, সিডনী হার্বার


হোটেলের সামনে এসে এবার সিজার সামান্য জোর করে।
: কী হয়েছে বলো আমাকে। এক ঘন্টার ব্যবধানে তোমাকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে আমার।
: আই এম ফাইন সিজার। ইটস ও-কে!
: তুমি কি আমার কোনো কথায় কষ্ট পেয়েছো?
আমেন্ডা মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে। সিজার জানতে চায় আবারো। আমেন্ডা চোখ তুলে তাকায়, তার চোখ লাল, টলমল করছে পানিতে। চকিতে সিজারের একটা হাত তুলে নিয়ে, তারায় চুমু খেয়ে দৌড়ে হোটেলে ঢুকে যায়। হতভম্ব সিজার তাকিয়ে থাকে সেদিকে, অনেক্ষণ।


পরিশেষ

- এর পরের ঘটনা আমরা আর জানি না। সিজারের সঙ্গে আমেন্ডার আর দেখা হয়েছিলো কীনা তাও জানি না আমরা। সিজার পরদিন খুব ভোরে সার্কুলার কী-তে ম্যাকডোনাল্ডসের সামনের ফুলের দোকানটা থেকে এক গোছা ভিন্নবর্ণের ফুলের তোড়া নিয়ে দুশ ছত্রিশ নাম্বার রুমের দরজায় নক করেছিলো কিনা তা জানা যায় নি। কোয়ান্টাসের বিভিন্ন মিটিংএ বসে আমেন্ডা সিজারকে একটার পর একটা এসএমএস করেছিলো কিনা তা আমরা জানি না। এই ঘটনার কিছুদিন পর সিজার নতুন গাড়ি কেনে। হোন্ডা সিভিক ৯২। ভালোবাসা দিবসে অনেক কষ্টে আমেন্ডার ঠিকানা যোগাড় করে সেই গাড়ির পেছনের সীট বোঝাই করে ফুলের তোড়া নিয়ে সিজার আমেন্ডার ঠিকানায় হাজির হয়েছিলো কিনা তা জানা যায় নি। সিজার অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আসার খবরে আমেন্ডা ফোন করেছিলো কিনা, কিংবা করলেও কী বলেছিলো সেটাও থেকে যায় আমাদের অজানা। আমরা জানি না সেদিন অপেরা হাউসের সামনে কোন কথাকে মনে ধরে আমেন্ডা গুটিয়ে নেয় নিজেকে। আমরা জানি না সিজার ও আমেন্ডা একে অপরকে সত্যিই পছন্দ করে ফেলেছিলো কীনা!

এথেন্সে রৌদ্রস্নানরত সেই যুবক উঠে যায়। পকেট থেকে নীল রঙের বিশ ইউরোর একটা নোট বের করে হাতের গ্লাসটা দিয়ে চাপা দেয় চেয়ারে। কালো চশমাটা নেড়ে ঠিক করে এগিয়ে যায় অদূরে থামিয়ে রাখা ছাদখোলা লাল মাজদার দিকে। গাড়ির ইঞ্জিন ঘরঘর শব্দে চালো হয়ে পেছন দিকে কিছু ধূসর ধোঁয়া ছড়িয়ে দেয়। রাস্তার ডান দিক ধরে গাড়িটি এগিয়ে যেতে থাকে সিনডাগমার দিকে। পেছন থেকে গাড়িটির গতি অনুসরণ করতে করতে আমরা ওপরে উঠে যাই সময়ের সিঁড়ি বেয়ে। আমাদের কানে ভেসে আসে এরকম একটা সঙ্গীত। আমরা জানি না, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের যুবকটির আসল গন্তব্য কোথায়...!

Friday, May 09, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০৬

জ্বর নেই গায়ে অথচ উপরের পাটির ঠোঁটে প্রমাণ সাইজের ক্ষেত্রফল দখল করে বুক ফুলিয়ে ফুঁড়ে উঠেছে কয়েকলক্ষ জ্বরঠোসা। অনুভূতির ব্যাপার তো আসে পরে, দৃষ্টিতেই কেমন কিম্ভুতকিমাকার ঠেকছে জায়গাটা। দেখে মনেহয় যেনো কোনো দুষ্টু বালিকা সিলেটী 'খামের' তাড়নায় আমার ঠোঁটে কামড়ে দিয়েছে!

অবশেষে বহুল প্রতীক্ষিত 'সামার' বাবুর দেখা মিললো। বসন্তের শুরুতে বরফের দেখা দেওয়া মনে বিলম্বিত সামার আসার পাগলা ঘন্টি বাজালেও খুব শীঘ্রই ললনাদের বসনে দুর্ভিক্ষের আভাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে আয়েশ করে। বেচারা চোখ দীর্ঘ নয় মাস পর কিছু কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে বটে কিন্তু মন বেচারা এবারও মিইয়ে থাকবে গ্রীষ্মসূধা পান হতে বিরত থেকে। এইটা একটা "নো-গুড সিচুয়েশন"। চারিদিকে অপার সৌন্দর্যের হাতছানি, আমি সবুজের কথা বলি না, বলি আশরাফুল মাখলুকাতের কথা! যদি হালায় বাজারের লাউয়ের লাহান ইট্টু ছুঁইয়া টুইয়া দেখতে পারতাম!

দুই উইকএন্ড আগে সকাল বেলা সাইকেল নিয়া বাইর হয়ে গেছিলাম সুন্দর একটা দিনের শুরু দেখে। তাপমাত্রা তখনো চান্দিতে এ্যাটাক করা শুরু করেনি। ট্রেনে করে সাইকেল সহ মোটামুটি কিছুদূর গিয়ে সাইকেলট্র্যাকে প্যাডেল মেরে ফিরতিপথ ধরেছিলাম। ১৭ কিলোমিটারের সেই পথটা আক্ষরিক অর্থেই ছবির মতো সুন্দর ছিলো। কখনো কান্ট্রিরোড, কখনো হাইওয়ের সমান্তরালে সরু দ্বিচক্রযানের পথ, সেই পথ আপেল বাগানের ভেতর দিয়ে গিয়ে পড়েছে (গজারী কিংবা পাইন গাছের) জঙ্গলে। মেঠো সেই পথে গীয়ার বদলে হু-হা করে প্যাডেল মেরে ফসলী জমিতে গিয়ে পড়েছি। এখানে শুঁকিয়ে যাওয়া কাঁদানাটির পথ। ট্র্যাক্টরের চাকার তৈরী ইয়া বড় গর্তে তখনো কিছু জমে থাকা পানি। সেই ফসলি জমি পেরিয়ে আবারও কান্ট্রিরোড। কিছুদূর গিয়েই পথটা ঢুকে গেলো একটা ছোট্ট লোকালয়ে। ছোট ছোট একতলা, দোচালা টালির ছাদের বাড়ি। কয়েকটার চিমনী দিয়ে দেখলাম ধোঁয়া উঠছে। শালারা পিচের কয়লা ব্যবহার করে ঘরে আগুন জ্বালাতে। আগের রাত গুলোতে ঠান্ডার প্রকোপটা খুব বেশি না হলেও একদম শূন্যের কাছে ছিলোনা! কুকুরের দড়ি হাতে দেখা মিললো গোটা কয়েক আবাল-বৃদ্ধা-ললনা। ললনা দেখে গতি কিছুটা মন্থর করে, কান থেকে ইয়ারফোনের ডিবলাটা খুলে হুদাহুদিই জিজ্ঞেস করলাম আমি সঠিক ট্র্যাকে আছি কীনা! সুন্দরী অবশ্য কুত্তার দড়ি হাত বদল করে আমাকে তর্জনী বাঁকিয়ে দেখিয়ে দেয় বাকিটা পথের নকশা। আমি সামনের দেখানো পথের দিকে তাকাই না, অপার শৈল্পীকতায় একজন হাওয়া সন্তানের হাতের নড়াচড়া খেয়াল করি ভালো করে। ঈমাণে কই, এই নড়াচড়ার ফলে কোন অঙ্গে কতোটা ঢেউ খাইয়াছিলো তাহা ব্যক্ত করিবার কোনো কুইজ থাকিলে আমি দশে দশ পাইয়া শিক্ষকদিগকে দেখাইয়া দিতাম বটে! কিন্তু আপাতত সে আশার গুড়ে ওড়লা। সময়টা আধা-মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না।

আমি আবারও প্যাডেলে ঘচাং করে পাড়া মারি। সাইকেল চলতে থাকে। খুব ছোট্ট একটা ঝোপ পেরিয়ে এবার এসে পড়ি বেশ ঢালু একটা জায়গায়। চূড়ায় থাকা আমি অনেক নিচে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পরিচিত সড়ক দেখতে পাই। তারও নিচে খাদ, সেই খাদ আবার উঁচু হতে হতে আরেক চূড়ায় গিয়ে ঠেকেছে। সেখানে আবার একটা লোকালয়ও আছে। সমান্তরাল রেখায় লোকালয়টি উচ্চতার দৃষ্টিতে আমার সমান হলেও মাঝখানে রয়েছে বিশাল এক দূরত্ব। দার্শনিক এরিস্টটলের মতো মাথা একবার এদিক আরেকবার ওদিক করে প্যাডেলে জোর দিলাম। সাইকেল আমার হাওয়ার বেগে নামতে লাগলো সর্পিল পথ বেয়ে, দুইপাশে বুক সমান উঁচু সরিষাক্ষেতের মাতানো সুগন্ধ নাকে গুঁজে দিয়ে। আমি মুহূর্তেই আমার গ্রামের হেমন্তের কোনো সকালে ফিরে গেলাম টুক করে।

গত সপ্তাহান্তে তীরুদা'র হঠাৎ নিমন্ত্রণে চলেও যাই হঠাৎ। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকাল সকাল পৌঁছানোর চেষ্টা করেও সেই তিপ্পান্ন সালের বদভ্যাস বশতঃ পৌঁছাই নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট পর। বদ্দা সুমন চৌধুরীকে চিনি আগে থেকেই, হিমু নামের কালবালিশ (কোলবালিশ না জনাব)কে হয়তো দেখেছি কলেজে, কিন্তু মনে না থাকার সম্ভাবনা নিরানব্বই শতাংশ। তীরুদার সঙ্গে কখনো সাক্ষাত হয় নি, আর সচল মিষ্টভাষী শাহীন ভাই- এই প্রথমবার।

স্টেশন থেকে বদ্দাই এগিয়ে নিতে এলেন। বললেন বাকীরা কাছে কোথাও আছে। অনেকেই হয়তো প্রমাদ গুণে রেখেছিলেন হিমু আর ধুসর এক জায়গায় হলে সেখানে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে বিয়ে নামক জিনিষের কিছু 'বাইপ্রোডাক্ট'কে কেন্দ্র করে। বদ্দাও হয়তো ধারণা করেছিলেন তাই-ই। ক্যাফেতে বসে থাকা তিনজনের মধ্যে তীরুদাকে সনাক্ত করা যায় খুব সহজেই। বাকী থাকলেন শাহীন ভাই আর আমাদের হিমু। হিমুকেও না চেনার কোনো কারণ নেই। ঝলমলে রৌদ্দূরে এক পশলা কয়লার বস্তা দেখলেই জনগণ মনে করতে পারেন ওটা হিমু, এতে হিমু'র সেন্টু খাওয়ারও কিছু নেই আর জনগণেরও ঈদের খুশিতে কোলাকুলি করার কিছু নেই। বদ্দার উদ্বেগকে ভুল প্রমাণিত করে বসলাম হিমুর পাশেই। হিমুও অত্যন্ত আতিথেয়তায় বরণ করলো আমাকে। আফটার অল দোস্ত মানুষতো!

এর পরের ঘটনা গুলোর বর্ণনা অবশ্য ভুলবাল হলেও কিছুমিছু উঠে এসেছে হিমুর ফিকশনে। তবে হিমু যে কথাটি বলতে ভুলে গেছে তা হলো আমাদের বনাগমনের অধ্যায়টা। কোথাও হাঁটতে যাওয়া বলে কাছেই একটা বনে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের। ওখানে আমি আর হিমু একবার পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হিমু বলে, দোস্ত এখন হাগতে পারলে ভালো লাগতো রে! আমি বলি, ঠিক। ওপেন এয়ার কনসার্ট!
হিমু অবশ্য শুয়ে শুয়ে হাগার কথা বলে। আমি শরীয়তে মানা আছে বলে গাছের ডালায় বসে হাগার প্রস্তাব দেই। ব্যাটা রাজী হয় না। আমাকে "এক চাপে হাগা, তার কলাকৌশল এবং তার উপকারিতা" নিয়ে পৌণে দশ মিনিটের একটা লেকচার দেয়। আমি বেকুবের মতো তব্দা লেগে শুনি। হাগেন আলোচনা আর বেশিদূর যায় না বদ্দার চলে আসাতে। হাজার হোক মুরুব্বি মানুষ তো!

হিমু তার পার্বত্য চট্টগ্রামের ট্র্যাকিং-এ ঘটে যাওয়া ঘটনার বেশ রোমহর্ষক বর্ণনা শোনায় আমাকে। বাঙালীরা কীভাবে পাহাড়ীদের শোষণ করছে তার একটা ধারনা পাই টার কাছ থেকে।

বান্দরবানে হানিমুন করার আশা ব্যক্ত করি তার কাছে। শুনে হিমু ঠোঁট কুঞ্চিত করে হাসে। আমি বুঝিনা এর মানে কী দাঁড়ায়।

: তুই যা ব্যাটা ঐখানে, তারপর টের পাবি হিমু কী চিজ!

অথবা-

: ডরাইস না দোস্ত। আমি তো থাকুমই তোর লগে। তোর আর ডর কী!

আমি মনে মনে ভাবি, না অন্য কিছুকে ডরাই না। আমার যতো ডর তোরে নিয়াই শালা!!

Thursday, April 24, 2008

ভালোবাসা দিবস, ন-হণ্যতে এবং একটি ডোভ মূর্তি

১.

আমরা একই স্কুলে পড়তাম। আমরা মানে আমি, আর সুষ্মিতা। নামে মিতা আর শুরুতে সু শব্দটি থাকলেও সুষ্মিতার মাঝে সুমিতা দেবীর মতোই খান্ডারনী স্বভাবটি রাজত্ব করেছে পুরোটা সময়, তার সুন্দরের সুষম বন্টনকে পাশ কাটিয়ে। আর সুমিত ভাষণ! 'তিনি থাকেন বাংলার প্রমিত ডিকশনারীতে, ভগবানের কৃপায় তাকে সুষ্মিতার শব্দ-পল্লীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর'।
বাংলা শব্দকোষে যে এরকম একটি শব্দ আদতে জলজ্যান্ত বিদ্যমান সেটাই দিব্যি অস্বীকার করে সে আমার চেহারা মুবারক খানা দেখলে।

নাইনে উঠে প্রথমবার সরাসরি কথা বলার আগ পর্যন্ত তার দেড় ক্রোশ দূরে থাকাটাই নিরাপদ মনে করতাম। সেই কথা বলা আর সামাজিক জীব হিসেবে পরিচয় পরিচিতির প্রথম পর্বের পর দূরত্বটা আরো আধাক্রোশ বাড়াতে বাধ্য হই আমি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অসহায় আবেদনে।

"কিন্তু কাহাতক আর! এভাবে তো আর চলে না! এর একটা বিহিত তো অবশ্যই করা লাগে!" - ফ্যারাডের মাথায় যেমন করে বুদ্ধি খেলে গেলো বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগে, ঠিক তেমনি আমার মাথায়ও ময়ূরীর নাচ নেচে গেলো বুদ্ধি!

সন্ধি!

"সাদা নিশান আর সাদা কপোত নিয়ে হাজির হবো তার সামনে। তারপর করজোরে জিজ্ঞাসা করবো এই অধমের প্রতি তার এহেন বিরাগের কী হেতু!" - বন্ধুদের এভাবে প্রস্তাবনাটা জানাতেই সোজা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো।

"এইসব কপোত-ফপোত রাখো মামা। রোমান্টিক কিছু ভাবো। এইসব উত্তম কুমার আমলের কবুতর মার্কা রোমান্সে কাম হইবো না। উল্টা নিজের নাকশার নকশা বদলাইয়া ফিরতে হইতে পারে...!"

আসলেই ভাবনার কথা। কিন্তু বন্ধুরা যেভাবে ভাবছে আমি সেভাবে ভাবতে পারছি না। কারণ অবশ্য আছে বেশ কয়েকটা। তার মধ্যে সবচাইতে ধর্তব্য যে কারণ সেটা হলো, 'আমার হাতে সাত-পাঁচ ভেবে কদম ফেলার পর্যাপ্ত সময় আর অবশিষ্ট নেই!'

এমনি নানা ভাবনার অতলে তলিয়ে যাবার আগেই বাদল বাঁচালো 'বই' নামক বয়া দিয়ে। সবাই সম্মতিও দিলো। পরের ঘটনাগুলোও ঘটে গেলো বেশ দ্রুত। বই কেনা হলো, সেটা আবার রাঙতা কাগজে মোড়ানোও হয়ে গেলো। ঠিক হলো পরদিনই সন্ধির আবেদন করা হবে সুষ্মিতার কাছে, সশরীরে।

ক্লাশ শেষ। বারান্দায় সুষ্মিতাকে দলছুট পেয়ে পাকড়াও করে ঘড়ির কাঁটার হিসেবে পৌণে একদিনের রিহার্সেল দেয়া আবেদনের কথাগুলো তোতাপাখির মতো গরগর করে উগড়ে দিলাম। আমার কথায় ও কি বুঝলো, কি বুঝলোনা সেটা ঠিক বুঝা গেলো না। তবে তার কথা থেকে আমি যা বুঝতে পারলাম তা হলো, 'সন্ধি নিয়ে কথা বলতে হলে সময়ের প্রয়োজন। আর আজকে সেটা সম্ভব না, কাল বিকেলে প্রাইভেট টিউটরের বাসা থেকে বের হয়ে কিছুটা সময় হাতে আছে। তখন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সন্ধি নিয়ে কথা হতে পারে!'

তা হতে পারে বৈকি! এই ভেবেই পরের দিন, নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ের পাক্কা দেড়ঘন্টা আগেই এসে বসে আছি। অংক পরীক্ষার মতো টেনশন হচ্ছে। পাটীগণিতের সুদ-কষায় প্যাচ লাগলে যেমনটা হয়। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা না তো! তবে কি আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কোন জটিল-ভেজাল-সমীকরণের আভাষ দিচ্ছে?

প্রত্যাশিত সময়ের কিছু আগেই সুষ্মিতার দেখা মিললো। কলাপাতা রঙের থ্রী-পিস, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, খুব ধীরে, দৃষ্টিনন্দন ভঙিমায় হেঁটে আসছে এদিকে। হাঁটার এই স্টাইলটি সুস্মিতার একদমই নিজস্ব। সুস্মিতাকে আসতে দেখে নির্জন জায়গাটি যেনো আরো নির্জন হয়ে গেলো হঠাৎ করেই। গাল বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা ঘাম পড়ে গেলো নিচে, অথচ আমার চারপাশে তখন কেমন যেনো শীতল একটা অনুভূতি। আলগোছে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া আমি, নীল রাঙতায় মোড়া সবুজ 'ন-হণ্যতে'টা আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম...।



২.

বিকেলটা একদমই সুবিধার না। সকালটা একটা ঝলমলে দিনের সূচনার কথা বললেও দুপুর থেকেই আকাশের মন চুপশে যেতে শুরু করেছে। যতোটা গর্জায় আকাশ নাকি ততোটা বর্ষায় না, সেটাই আপাতত আশার কথা। না হলে ছোট্ট ছাতায়, মাথা কাকভেজা হওয়া থেকে বাঁচলেও রাধিকার বস্ত্র শেষরক্ষা পাবে না!

উফ, কালকে এই বদ ছোরাটা আমাকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিয়েছিলো একেবারে। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে সামনে এসে খই ভাজার মতো পটপট করে কি সব ঘোড়ার মাথা বলা শুরু করলো! স্কুলের বারান্দায় তার অতর্কিত প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়াটা মোটেই প্রত্যাশিত ছিলো না। ভড়কে যে গিয়েছিলাম সেটা ঢাকার জন্যই তো এই নাকাবন্দী! 'কী হবে, কী বলবে'- এই ভাবনাটা সারাটাক্ষণই তটস্থ করে রেখেছে।

পড়তে আসার আগে নিজের সবচাইতে পছন্দের জামাটা পরেছি। বাসা থেকে বেরুবার আগে ছোট মামার দেয়া আমার সবচাইতে সুন্দর ডোভ মূর্তিটা ব্যাগে নিয়েছি। আচ্ছা, ও উলটা পালটা কিছু করবে নাতো! ধুর, কি সব ভাবছি। ওর চোখ দেখে মনে হয় না ঝামেলা করতে পারে।

কিন্তু যদি এমন কিছু করেই ফেলে তখন! তার চাইতে বোধহয় না গেলেই ভালো হয়। যাহ্, এখনতো মনেহচ্ছে দোটানায় পড়ে গেলাম। একমন বলে যেতে, আরেক মন বলে না যেতে। মহা ঝামেলায় পড়া গেলো তো!

এম্পটি জ্যাকফ্রুট চান্দু, দেখলেই রাগ চিরচিরিয়ে ওঠে। সারাক্ষণ পিন্ডি জ্বালানো আলটপকা মন্তব্য! সেদিন আগ বাড়িয়ে পরিচিত হতে এসেছে। আরে ব্যাটা তোকে তো আমি সেদিন থেকেই চিনি যেদিন স্কুল ফাংশনে গান গাওয়ার রিহার্সেলের পর বলেছিলি, "গলা তো না যেনো ফাটা বাঁশ তাও আবার দুই নম্বর সূই-সূতা দিয়ে সেলাই করা!"

আমাকে আড়ালে সুই-সূতা বলে ক্ষেপাস ব্যাটা বদের হাড্ডি। যেতে ইচ্ছে করছে না একদম। রাগ চড়ে যাচ্ছে। তোর সাথে কোনো সন্ধি নাই, যা ভাগ!

এক সঙ্গে পড়তে আসা মেরী খোঁচা দিয়ে বলে, "কী রে, দাঁত কিড়মিড়িয়ে আছিস কেনো!" আমি হেসে ফেলি, ডে ড্রীম!

যাবো না যাবো না করেও শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের কাছে হার মানতেই হলো। দেখাই যাক না চান্দু কী বলে!

দূর থেকে দেখেই নার্ভাস মনে হচ্ছিলো তাকে। প্রতি সেকেন্ডেই নড়েচড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে যেনো কাঁটার পিড়িতে কেউ জোর করে বসিয়ে দিয়েছে। একটু পরপর সাদা কিছুতে মুখ মুছছে। ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে আছে দেখে হঠাৎই মায়া হলো। আহারে বেচারা! তাড়াহুড়ো করে গেলে ভয় পেয়ে উঠে দৌঁড় লাগাতে পারে। আর আস্তে গেলে নিজের ধুপধুপ আওয়াজটাও একটু নিয়ন্ত্রনে আসবে।



৩.

সুষ্মিতা যেমনি ধীরে হেঁটে এসেছে ঠিক তেমনি ধীরে বসলো, ঠিক যেনো সবুজ রঙের কোনো বার্বির মতো। যেনো কোনোই তাড়া নেই তার। আকাশের অবস্থাও সুবিধার না, সেদিকেও ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। ব্যাগে ছাতা আছে কী না কে জানে! বৃষ্টি মাথায় করে যাওয়াটা নিশ্চই শোভন হবে না পাতলা থ্রী-পিস পরা এক বঙ্গ-ললনার জন্য। গুমোট আবহাওয়ায় ভ্যাপসা গরমে আমার অবস্থা তথৈবচ। জামা ভিজে চুপচুপ করছে, আসার পথে কেনা সুগন্ধি টিস্যুর প্যাকেটেও শেষ কয়েকটা আছে। ওগুলো দিয়ে ঘাম মুছে ফেললে সন্ধির সাদা নিশান পাবো কই! পরিস্থিতি বিগড়ে যাবার আগেই বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজটা সেরে ফেলা উচিৎ। 'ওহ্ গড আই ডোন্ট হ্যাভ এনাফ টাইম ফর দ্যাট!'



৪.

অনেকক্ষণ হয়ে গেলো কেউ ই কোনো কথা বলছি না। বরফ ভাঙলো সাগর নিজেই। 'ফ্যাঁ'র প্যাকেট থেকে একটা সাদা টিস্যু বের করতেই জুঁই ফুলের মাতাল করা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। টিস্যুটি আমার সামনে বিছিয়ে বললো, "এইযে সাদা কেতন! চলো এবার সন্ধি করি..."

আমার কেনো যেনো খুব হাসি পেলো। সাগরের বলার ভঙিটার কারণেই বোধহয়। হেসে তার টিস্যুটি কুড়িয়ে নিয়ে বললাম, "না থাক। তার চাইতে চলো গল্প করি! সন্ধি করা লাগবে না, ঝগড়া মিটমাট!" মনে মনে ভাবি, তুমি ডাকতে এতো দেরী করলে কেনো বোকা ছেলে!

হালকা-মজার গল্পে মনের ভেতরে পুষে রাখা রাগটা উবে চলে যায় সাগরের ওপর থেকে। এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা বোধহয় ঠিক হবে না আর। যেকোনো মুহূর্তেই ঝুপ করে নেমে আসতে পারে বৃষ্টি। কয়েক ফোঁটা ইতোমধ্যেই টুপাটুপ আদর করে গেছে ধরনীকে। সাগরকে বলতে সেও মাথা নেড়ে সায় দিলো। "চলো তবে ওঠা যাক"- বলেই তড়াক করে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি ব্যাগ থেকে সাদা ডোভ মূর্তিটা হাতে নিয়ে, দাঁড়িয়ে সেটা সাগরের দিকে বাড়িয়ে বলি, "নাও এটা তোমার জন্য। আমার সবচেয়ে প্রিয়...।"

সাগর মনে হয় প্রস্তুত ছিলো না এর জন্য। ওর হা করা মুখটাও দেখার মতো ছিলো। খুব হাসি পাচ্ছিলো আমার বেচারার করুণ চেহারা দেখে! কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি নির্ঘ্যাৎ। 'ওহে তব্দা খাওয়া বালক, স্বয়ং বিধাতাই নারীর মন বোঝেনি, তুমিতো এক নগণ্য আদম সন্তান!'



৫.

সুষ্মিতা আমাকে অবাক করে দিয়ে যে ডোভ মূর্তিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো সেটা বিখ্যাত এক শহরের পাবলিক স্কয়ারে রাখা ভাস্কর্য। প্রেমের শহরে, ভালোবাসার নিদর্শন বুঝায় অপ্সরার মাথা ওয়ালা এই ডোভটি। সেই শহরের ঐতিহ্য অনুযায়ী 'ডোভ মূর্তিটি উপহার হিসেবে দেয়া মানে প্রেম নিবেদন' - এই কথাটা কি বোকা মেয়েটা জানে!

জেনে দিক, আর না জেনেই দিক। এখন তো মনে হয় আমারও কিছু দেয়া উচিৎ তাকে। কিন্তু কীভাবে যে দিই!

ছাতা খুলে ধরা সুষ্মিতাকে বললাম, "তুমি কি চোখ দু'টো একটু সময়ের জন্য বন্ধ করবে প্লীজ। আর হ্যাঁ, আমি না বলা পর্যন্ত খুলবে না- এটাও একটা প্লীজ...!"



৬.

সাগরের হাতে সেই তখন থেকেই একটা নীল প্যাকেট দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার জন্যই এনে থাকবে হয়তো, অথচ দিচ্ছে না! প্যাকেটটা আমার জন্যই কী না, সেটাও জিজ্ঞেস করতে পারছি না। এমনওতো হতে পারে তাকে আজকের দিনে অন্যকেউ দিয়েছে, কিংবা সে কাউকে দিতে এনেছে! অন্যকারো জন্য হলে, তখন লজ্জা পাবো ভীষন। তার চেয়ে কৌতুহল অবদমন করে রাখাই শ্রেয়। ওর চোখ বন্ধ করার অনুরোধ আর অনুরোধের ধরণ শুনে আরও এক পশলা হাসি পেলো। হাসি মুখেই চোখ বন্ধ করলাম, জোরে, হাত সামনে বাড়িয়ে...!

এক মুহূর্ত- দুই মুহূর্ত- তিন মুহূর্ত!

কী ব্যাপার ব্যাটা কিছু দেয় না কেনো হাতে! কী ভাবছে তাই চিন্তা করছি। 'আরে ব্যাটা দিবিই যখন দিয়ে দে, আর কতোক্ষণ আন্ধা বানিয়ে রাখবি!'

চার মুহূর্ত- পাঁচ মুহূর্ত- ছয় মুহূর্ত- হঠাৎ...!

মুখের ওপর উষ্ণ এক চাপ অনুভব করলাম আমি। উষ্ণ-ভেজা চাপ। আমার দম বন্ধ হয়ে এলো, সারা শরীর শিউরে উঠলো। পা টলে উঠলো, যেনো সমস্ত শক্তি হুট করে চলে গেলো আমাকে ছেড়ে। কাঁধ থেকে ব্যাগটা টুপ করে পড়ে গেলো, নিজেকে হঠাৎই খুব হালকা মনে হলো, খুবই! যেনো বকের পালকের মতো আমি ভেসে যাচ্ছি... ভেসে যাচ্ছি বাতাসে দোল খেতে খেতে...!

অনুভব করলাম, সাগরের হাত আমার হাতটা টেনে ধরেছে। শক্ত কিছু একটা ধরিয়ে দিয়ে কানের কাছে ফিশফিশ করে বললো, "ভালো থেকো তবে!"

ভালোলাগা নেশায় আরও কিছুক্ষণ ডুবে থেকে চোখ খুললাম। সাগর তখনো চোখের আড়াল হয়ে যায় নি। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। হাতের নীল রাঙতা মোড়ানো প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করি, "বেকুবটা কি জানতো আজ ফেব্রুয়ারীর কতো তারিখ!"



৭.

এই বৃষ্টিস্নাত বিকেলটাই নিজবাসভূমে সাগরের কৈশোর জীবনের ইতি। সে রাতেই পশ্চিমাগামী এক উড়ানে চেপে বসে সে। পশ্চিমেই হবে তার বাকী পড়াশুনা, আলাদা হয়ে যাওয়া বাবা-মা, মেঝো চাচার এটাই ইচ্ছা। সাগরের ইচ্ছেটাও ওরকমই ছিলো। বাবা-মার থেকে অনেক দূরে থাকতে পারলেই সে বাঁচে। কিন্তু এখন মাঝরাতের কোন উড়ানের উইন্ডো সীটে বসে, পাশের কাঁচের জানালার ওপাশে গড়িয়ে পড়া পানির সর্পিল রেখা দেখতে দেখতে সাগরের অদম্য ইচ্ছে হয় ছুটে বেরিয়ে যায় এই উড়ান থেকে। এক ভোঁ-দৌঁড়ে চলে যায় বন্দর ছেড়ে।

উড়ান চলতে শুরু করে, সাগরের কিশোর বুকটা দুমড়ে যেতে থাকে যেনো উড়ানের চাকাগুলো গড়ায় সেখানেই। লুকিয়ে হাতের উলটো পাশে চোখ মুছে সাগর। পাশে বসা মেঝো চাচা মাথায় হাত বুলিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলেন, "বাবা-মার কথা মনে পড়ছে খুব, না রে!"
সাগর ইয়ার ফোনের প্লাগটা কানে গুঁজে দেয়। ৬ নম্বর স্টেশন থেকে মস্তিষ্কে সোজা আঘাত করে হিউম্যান নেচার। সামটাইমস আই উইশ দ্যাট আই কুড টার্ণ ব্যাক টাইম...



৮.
সুষ্মিতা ঘোরে থেকেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো চোখ খুলে দেখতে পায় সাগর হেঁটে অনেকটা দূর চলে গেছে। সাগরের চলে যাওয়াটা উপলব্ধি করার অবস্থায় সে তখনও আসেনি। ঠিক এই মুহূর্তে সুষ্মিতার মনে হয় তার চাইতে সুখী আর কেউ নেই। শিরা-উপশিরা গুলো অদ্ভুত এক চঞ্চল আনন্দ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার সারা শরীরে। চারপাশের সবকিছুই অসম্ভব ভালো লাগতে শুরু করে। মুখে মিষ্টি একটা স্বাদ লেগে আছে। ব্যাগটা আস্তে করে তুলে নিয়ে, নীল রাঙতা মোড়ানো প্যাকেটটা শক্ত হাতে ধরে সে ঘরে ফিরে আসে।

অনেক রাতে টেবিল ল্যাম্পের মৃদু-মায়াবী আলোয় প্যাকেটটা খোলে সুষ্মিতা। ন-হণ্যতে।
সাদা জায়গায় গাঢ় সবুজ কালিতে সাগরের হাতের লেখা- "তোমাকেই দিলাম"। বইটা হাতে নিয়ে সুষ্মিতা উল্টে-পাল্টে দেখে, নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেয়, চোখ বন্ধ করে বিকেলের সেই পাগল করা অনুভবটা পেতে চেষ্টা করে আবার। সাগর- তার হাত- লম্বা লম্বা আঙুল- সুষ্মিতার চোখ বন্ধ- মুখে উষ্ণ তীব্র চাপের ভেজা স্পর্শ!



শেষ.

সুষ্মিতার জানালার বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, বাইরে থেকে জানালায় কান পাতলে ভেতর থেকে খুব আবছা আওয়াজে ঈগলসে'র 'লাভ উইল কীপ আস এ্যালাইভ' গানটা ভেসে আসে। সুষ্মিতার জানালা থেকে সরে আসার সময় কাছেই কোথাও হঠাৎ বজ্রপাতের তীব্র শব্দ হয়। নীলচে আলোয় ভরে ওঠে চারদিক। সুষ্মিতা-সাগরের জন্য আকাশের যেনো অনেক কষ্ট, সেই কষ্টেই বুঝি নীল হয়ে যাচ্ছে সে বারবার।

সুষ্মিতা জানলো না এই গল্পটির পথ কোন দিকে যাবে, কোথায় গিয়ে শেষ হবে এই গল্প!

সাগর ও সুস্মিতার এর মাঝে আর কখনোই দেখা হয়নি, কথা হয়নি, যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে তারা একই শহরে বাস করে, তাদের হঠাৎ দেখাও হয়ে যায়, কিন্তু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, বড্ড ভুল সময়ে। অপ্সরার মাথা ওয়ালা বিশাল ডোভ মূর্তিটির নীচে ঝিরঝির বৃষ্টির মাঝে অনবরত কথা বলতে থাকা ফুটফুটে একটি বাচ্চা মেয়ের তুলার মতো নরম হাত ধরে, সাগর দাঁড়িয়ে দেখে, সেদিনের সেই কলাপাতা রঙের সুস্মিতার পাশে আজ অন্য কেউ, অন্য কোনো প্রয়োজনে!

"ড্যা-ডি, হোয়েন উইল উই গো টু মাম্মী!"

কথা বলা পুতুলটির টানে সম্বিৎ ফিরে পায় সাগর। স্টেফানী, অনেক ভালোবাসতো তাকে। প্রতি সপ্তাহের এই দিনে মেয়েকে নিয়ে সে বউয়ের কবরের দিকে যায়!

Monday, April 14, 2008

একটি গোলাপের আদর

: হ্যালো...
তুই অনেক ঘুম জড়ানো কন্ঠে ওপাশ থেকে বললি।

: ঘুমাচ্ছিস বুঝি!
: ছুটির দিন, ভোর বেলা লোকজন তো ঘুমাবেই নাকি?
: তা ঘুমাবে যদি না আমার মতো কেউ হঠাৎ ফোন করনে ওয়ালা না থাকে।
: হুমমম
: যদি বলতে পারিস কেনো ফোন করেছি তাহলে তোকে ইউরেনাস গ্রহটা লিখে দিয়ে দেবো!
: এতো বড় গ্রহ নিয়ে আমি কী করবো! রাখবো কই!
: আচ্ছা তাহলে যা, তোকে শনি গ্রহের একটা বলয় লিখে দেবো।
: হে, ওখানে বসে বসে কি পা ঝুলাবো আমি? লাগবে না আমার।
: আরে ভেবে দেখ, একেবারে ৫০০ টাকার স্ট্যাম্পে দস্তখত দিয়ে লিখে দেবো, ঈমানে কই।
: তুই কি পুরা সৌরজগতের লীজ নিলি নাকি?
: আরে তুই একবার বলে তো দেখ, তোকে গোটা ছায়াপথটাই ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো ধূমকেতুর ল্যাজে চড়িয়ে।
: হইছে থাম থাম। পরে পিছলা খাইয়া পড়ুম।

আমার আজকে কী হলো, রাজ্যের ক্ষুধা পেয়ে বসলো। ক্ষুধায় আমার কথা জড়িয়ে এলো। ঘুমজড়ানো গলায় তোর কথা বুঝি না, ক্ষুধায় চোটে নিজের গলায় কথা সরে না।

: পেটে আমার জ্বলন্ত ক্ষুধা, বুকে আমার খাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা। কী যে করি!
: ক্ষুধা লাগলে খা। ঘরে কিছু নাই?
: আছে তো, কিন্তু আমার যে ঢেঁড়স ভাজি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে কাগজি লেবু চটকিয়ে।
: ঈশ, ঢেঁড়স জিনিষটা আমার একদম পছন্দ না আর এটার কথাই বললি!
: তোকে শিখিয়ে দিই কীভাবে ঢেঁরষ ভাজতে হয়। প্রথমে একটা কড়াইয়ে তেল গরমল করবি...
: আমি জানি কীভাবে ঢেঁড়স ভাজি করতে হয়।
: ওহ্, তাও জানিস! কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছে করছে যে।
: এক কাজ কর। তুই তোর পরিকল্পনা মতো হালচাষ শুরু করে দে। তখন দেখবি কেউ গামছায় বেঁধে তোর জন্য ধোঁয়া ওঠা ভাত আর ঢেঁড়স ভাজি নিয়ে আসছে। তুই সেগুলো ক্ষেতের আলে বসে বসে খাবি।
: মশকরা করস? ক্ষুধার্তের সঙ্গে মশকরা করা কিন্তু ঠিক না। ক্ষুধা বেরাজি হয়।
: মশকরা কই করলাম। হাজার মাইল দূরে তোর জন্য ঢেঁড়স ভাজি করে কে নিয়ে যাবে? এক কাজ কর, বেরিয়ে যা ঘর থেকে।
: বের করে দিচ্ছিস?
: আরে, বের করে দিচ্ছি না বেকুব। বলছি বাজারে যা, ঢেঁড়স কিনে নিয়ে আয়।
: কোথায় যাবো, কারওয়ান বাজার নাকি দক্ষিনখান?
: থাক যাওয়া লাগবে না, বসে থাক।

তুই বললি আমি নাকি আজ স্বপ্নে ঢেঁড়স দেখবো। আস্ত জলজ্যান্ত, নিরীহ মুখের একটা ঢেঁড়স, তার দিকে আমি ছুরি উঁচিয়ে যাচ্ছি। ঢেঁড়সটা ভয় পেয়ে ছুটে যাচ্ছে, আমি পেছন পেছন দৌড়াচ্ছি। তুই এই সব কথা কোত্থেকে বলিস কে জানে। আমার দারুণ লাগে, ভালোলাগে। নইলে ক্ষুধা পেটে আমি এতো মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলি!

: চোখ বন্ধ করে আছিস এখনো?
: তুই কি দেখতে পাচ্ছিস!
: নাহ্, তা পাচ্ছি না।
: তো বলছিস যে!
: চোখ খোল।
: মাথা ব্যাথা করবে যে!
: করলে করবে, চোখ খোল তোকে একটা কথা বলবো।
: নে খুললাম, এবার বল।
: উঠে বস।
: উফ, আবার বসতে হবে কেনো!
: আহা, বোস ই না।

তোর ঘুম জড়ানো কন্ঠ গলে কী বের হলো, কিছুই বুঝলাম না।

: হুমম, তুই খালি ঝামেলা করিস।
: হাহাহা
: আমার ঘুম পুরো হয়নি। মিনিমাম আরও ঘন্টা তিনেকের কোর্স।
: হুমম, বসেছিস, চোখ খোলা?
: হ্যাঁ তো...
: শুভ নববর্ষ
: হাহাহা... পারিসও তুই। তোকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

: তুই আমার জন্য একটা কাজ করবি? এটা একটা প্লিজ!
: হুমম, বল।
: করবি তো!
: আহা, বল ই না। বললাম তো রে বাবা করবো।
: তুই কখনো খুব সকালে ঘুম থেকে উঠিস?
: উঠি তো মাঝে মাঝে।
: হুমম। আমার জন্য একদিন উঠবি। অনেক সকালে। সূর্য ওঠার আগে। উঠে ছাদে যাবি। আচ্ছা তোদের ছাদে যাওয়া যায়?
: হ্যাঁ, যায়। কিন্তু এতো সকালে ছাদ তালা দেয়া থাকে যে!
: চাবি নিয়ে রাখবি কোনো একদিন। পারবি না।
: হুমম পারবো।
: ছাদে গিয়ে কী করবি?
: তালা খুলবো, তারপর লাগিয়ে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়বো!
: তোরে কি আমি তালা খোলা আর লাগানোর জন্য এই ভোর বেলা উঠতে বলছি?
: তো কী করবো, বলিসনিতো!
: হুমম। ঘুম থেকে উঠে চোখে মুখে পানি দিবি। একটু শীত শীত লাগলে ওড়নাটা চাদরের মতো করে জড়িয়ে নিবি। তারপর ছাদে যাবি। রেলিঙ ধরে দাঁড়াবি সূর্যোদয়ের আগে। তোর চোখের সামনে দিয়ে সূর্য উঠবে। তখনকার তোর একটা স্কেচ করে আমাকে দিবি, পারবি না!
: আমি কি আঁকতে পারি নাকি। স্কেচ করবো কী করে!
: আরে, স্কেচ কেবল পেন্সিলেই হতে হবে কেনো। বাক্যের গঠনেও তো হতে পারে। তুই সেটাই করবি। আমি দেখবো তোকে, ভোরের তোকে কেমন লাগে।
: কেমন লাগবে আমি জানি। ঘুমে চোখ ফোলা ফোলা, চুল খাড়া হয়ে থাকবে। আচ্ছা, বারান্দায় হলে হয় না?
: নাহ্, কেনো!
: আমাদের ছাদটানা খুব খারাপ। রেলিং খুব নিচু। ঘুমের ঘোরে যদি পড়ে যাই। তখন স্কেচ আঁকা বাদ দিয়ে তো জীবনের হালখাতা করতে হবে!
: হুমম, চিন্তার কথা। একটা কাজ করা যায়। ছাদে উঠেই মোটা একটা রশি নিয়ে কোমড়ে বেঁধে তার আরেক মাথা স্টেবল কোনো কিছুতে বেঁধে রাখতে পারিস। তাহলে পড়ে গেলেও ঝুলে থাকবি।
: হে, মাংকি জাম্পের মতো! আমার অনেক ভালো লাগে মাংকি জাম্প। দিতে না, দেখতে। লোকজন আআআ করে চিৎকার করতে থাকে।
: নেপালে করা যায় মনে হয়।
: তাই নাকি!
: তবে তোর সুবিধা হবে না। তুই কইলজ্যা ফাইট্যা মরে যাবি। আআআ করে চিৎকার দিয়েই তুই শেষ।
: হাহাহা, তা ঠিক।

তোকে, তোর শুভ্রতাকে ভোরের আলোর কুমারী শুভ্রতায় উপলব্ধি করার প্রবল বাসনা আমার। কোনোদিন হয়তো এই সময়টায় তোকে সামনে থেকে দেখা হবে না আমার। কপালের দোষ দেবো তোর মতো!

: তোকে একটা কথা বলতে চাই, বলবো!
: হুমমম
: না থাক, বলবো না।
: আমি শুনবো, বল।
: আমি আসলে বুঝতে পারছি না, বলাটা ঠিক হবে কীনা।
: হবে, বল।
: নারে, থাকুক কথাটা না বলাই।
: অর্ধেক কথা বলে! আর বলতে বলবো না। তুই তখন প্যাচাবি।
: থাক, বলিস না আর।

ভারী হয়ে যাওয়া আলাপ একটু হালকা করতে চাই। সিরিয়াস কোনো আলাপের সময় আমার মুখে কুলুপ এঁটে যায়, মেপে মেপে কথা বের হয়। তোর ও কি এমনটা হয়?

: তোকে আবহাওয়ার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিই!
: হুমম
: সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঝলমলে রোদ। তারপর দুপুরের দিকে মন খারাপ করে দিলো আকাশ। একটু কাঁদলোও বোধহয়। বিকেলের একটু আগে আবার হাসি ফোটালো ঠোঁটে। কিন্তু বিকেলে গড়িয়ে সন্ধ্যায় আবার সেই মন খারাপ করা রূপ। বৃষ্টি না হলেও ভ্যাপসা একটা পরিস্থিতি। আর এখন, গুড়িগুড়ি ঝরছে। এখন বৃষ্টির পানি বেয়ে পড়া দেখি।
: পানি পড়া দিবি নাকি?
: কেনো, তুই দিবি?
: নাহ্, ঐটা তোরই কাজ। তুই ই দে।
: হাহাহা, তোর মনে আছে!
: হুমম, হাহাহা। আচ্ছা তুই কি বাইরে!
: হুমম
: বাইরে কী করিস!
: গাছ খুঁজি। তোকে শুভেচ্ছা জানালাম শোয়া থেকে বসিয়ে। এখন আমি গাছে চড়বো, আর তুই আমাকে শুভেচ্ছা জানাবি। হাহাহা
: হাহাহা

দুজনেই হেসে উঠি। একেবারে অকারণ, গুরুত্বহীন এবং নির্ভেজাল একটা হাসি। তোর হাসি চলতে চলতেই ভাবি একটা ধাক্কা দিই তোকে-

: আচ্ছা তুই আমার বউ হবি?
: তোর মতো পাগলের বউ হবার কোনো ইচ্ছা আমার নাই।
: তোরে কোন হালা বিয়ে করবে শুনি?
: আরে করবে করবে। খুব শীঘ্রই আমার বিবাহ হবে।
: ঐ হালার ঠ্যাং ভাংবো দাড়া।
: না না, ঠ্যাং ভাঙিস না। বেচারা অনেক ভালো মানুষ হবে রে!
: তাইলে তোরে বিয়ে করতে আসে কেনো!
: তো তুই কি চাস, কোনো খারাপ মানুষ আমাকে বিয়ে করুক!
: আমি তো চাই তোর বিয়েই না হোক। হাহাহা
: হ, তোর তো যতো খারাপ বুদ্ধি!

আলাপটা এর চেয়ে বেশিদূর যাবার দরকার নেই বোধহয়। তুই অনেক বুদ্ধিমতি...। আর আমারতো পায়ে বোম মেরেও এর চেয়ে সামনে আগানো যাবে না।

: আচ্ছা শোন। তুই ঘুমা আবার। অনেক সময় নিলাম তোর।
: হুমম। কতোক্ষণ নিলি, ক'টা বাজে এখন।
: সাড়ে আটটা।
: হুমম, দেড় ঘন্টার মতো।
: উঠে কী করবি!
: আরও ধর ঘন্টা খানেক ঘুমাবো। আমি এখনো চোখ খুলতে পারছি না। উঠে ঘর গোছাবো। টুকটুক যা কাজ আছে করে ফেলবো। বিকেলে হয়তো বেরুবো। তোর কাজ আছে না আজ!
: নাহ্, আজকে সারা বিশ্বজগতে সরকারী ছুটি, তুই ঘর গোছাবি যে!
: হাহাহা
: রাখি রে।
: শোন--- শুভনববর্ষ
: হুমম, তোকেও।
- এবং অটো ডিসকানেক্ট!

তোর সঙ্গে কথা শেষ হবার পরে পুরো ফিল্ম স্ট্রিপের মতো করে সামনে দিয়ে চলে গেলো একেকটা দিন-ক্ষণ-মুহূর্ত। তুই বলিস ইমোশনাল আমি বলি এসকেপিস্ট। তুই জানিস আমি হারতে পছন্দ করিনা। আমি প্রয়োজনে নিজেকে কলয়ডাল অবস্থায় নিয়ে যাই চাপতে চাপতে। অন্য কোনো অধ্যায় শুরু করে দিই, সবার অন্তরালে। সবাই ভাবে, এটাই সত্যি, তুইও কি তাই ভাবিস?

তোকে প্রথম যখন দেখেছিলাম, হেমন্তের দুপুরে, সন্ধ্যায় কার্ডিগান গায়ে, ভালো লেগে গিয়েছিলো তোকে। তখনও জানতাম না তোর ব্যাপারে। যেদিন জানলাম, তোর মন অন্যকারো সঙ্গে বাঁধা, তোর কসম করে বলছি- ভয়ানক কষ্ট পেয়েছি আমি। কখনো কি কাউকে কিংবা তোকে বুঝতে দিয়েছি? দেইনি। কিংবা তুই বুঝিসনি।

সবার চোখে ধূলো দিতে, এমন একটা কিছু করলাম- তুই নিজেও গোল পাকিয়ে ফেলেছিলি, বোধহয়। তুই কি কখনো খেয়াল করতিস তোর সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগতো সবচেয়ে বেশি। গালের কোনে কিংবা কানের লতিতে সামান্য রক্তিম আভাও হয়তো ছড়িয়ে পড়তো সন্তর্পনে, খেয়াল করতি কি? সামান্য একটু সুযোগ খুঁজতাম শুধু তোর সাথে কয়েকটা সেকেন্ড সময় কাটানোর জন্য। তুই বুঝিসনি কিছুই, না!

তোদের সম্পর্কটা যখন ভেঙে যাচ্ছিলো, সবচেয়ে বেশি কনসার্ণ কি আমি দেখাইনি? কী করবো বল। আমি যে এরকমই। তোর সাথে পরিচয়ের আগে বা পরে, যখনই খুব কাছের কিংবা প্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে, আমি নিজে চেষ্টা করেছি, বুঝিয়েছি সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য। তুই প্রমাণ চাস, দিতে পারবো! কিন্তু কেনো এমন করছি, তা কি তুই তখন কিছুই আঁচ করতে পারিসনি, নাকি করতে চাসনি!

তুই, আমি, আমরা সবাই বড় হয়ে গেছিরে অনেক। অনেক গুলো দিন-মাস-বছর পেছনে ফেলে রেখে এসেছি। সময়ের সাথে সাথে আমরাও একটু একটু করে বিদগ্ধ হয়ে উঠেছি কিংবা উঠছি। সবদিক ভাবতে শিখেছি, তুই শিখেছিস। অংকে ভালো ছিলি, হিসাবেও তাই কাঁচা নস। মন কিংবা ইমোশন বাদ দিয়ে তুই হিসাব করতে পারিস, কর্পোরেট রোবট হয়েই গেলি তবে। আর আমি দিনমান রোবটদের সঙ্গে কাটিয়েও রোবটের মতো হতে পারলাম নারে। আফসোসটা রয়েই গেলো। তুই ভালো থাকিসতো! অনেক ভালো, যতোটা ভালো থাকলে তুই ঝলমলে আলোর মতো না, বরং ঝুমাঝুম বৃষ্টির মতো সারাক্ষণ হাসতে পারিস। আমি তোর সেই হাসি শুনবো কান পেতে, উপলব্ধি করবো হৃদয় দিয়ে।
"মোর হিয়া যে বাঁধিনো তোমারই হিয়ার সনে"- কতদূর যাবি বলতো! পরকীয়া করবো তোর সাথে। কি, করবি না!

Thursday, April 10, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০৫

ঘরে ঢুকে পিসি'র দিকে তাকাতেই দেখি এভিজি তার ছেলেপুলে, নাতিপুতি সহ আমার পেয়ারের ডেলের ওপর খবরদারী করছে। কপাট ভেঙে তার প্রতিটা ঘরে ঘরে হানা দিচ্ছে কী সব আবোল তাবোল সন্দেহজনক হামলাকারীর খোঁজে। পাশে তাকিয়ে দেখি দাঁত কেলিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসছে হুকুমের আসামী, এক্ষেত্রে স্বরাস্ট্রমন্ত্রী আমারি স্বনামধন্য ছোট ভাই। ওর হাসি দেখেই আমার ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো! বুঝলাম ঘটনা খারাপ, শুধু খারাপই না- বেজায় খারাপ।

হাজার চারেক সন্দেহজনক হামলাকারী খুঁজে বের করে দিয়ে যখন এভিজি সাহেব বিদেয় নিলেন, তখন ডাক পড়লো আমার। কারণটা আগেই আন্দাজ করা ছিলো। বেচারা কম্পু স্টার্ট হতে নাকি অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। ঘুরে ফিরে খালি ওয়েলকাম স্ক্রীণে চলে যায়। আমি অবশ্য আমার ডাক পড়ার আগেই হাতুরি-বাঁটাল নিয়ে রেডি হয়ে ছিলাম। ডাক পড়াটা কেবল সময়ের দাবী ছিলো মাত্র! ঘটনা নতুন না তো। এই যেমন নয়া নতুন সনি'র পি-টু হান্ড্রেড কিনে দেয়ার মাস খানেকের মধ্যে ফ্ল্যাশ গন। তারও আগে আমার স্বাধের তোশিবা স্যাটেলাইট সিরিজের কপালেও ভালো কিছু জোটেনি, পিলিপস এমপিথ্রি প্লেয়ার, গেলো তার কন্ট্রোল নষ্ট হয়ে, একটা ডেস্কটপ পড়ে আছে টেবিলের কোণায়, এগুলো অবশ্য কোনোটাই বেচারা ছোটভাইয়ের দোষ না। জিনিষ গুলোই হঠাৎ মানুষের মতো আচরণ করে বিগড়ে বসলো। সেই ধারাবাহিকতায় এই ব্যাটা ডেল ইন্সপাইরন যে গত কয়েকটা মাস কী করে সার্ভাইভ করলো সেটাই অষ্টম আশ্চর্য আমার কাছে।

রাতে ঘরে ফিরে চালিয়ে দিলাম এক্সপি। উদ্দেশ্য এভিজি মিয়া যা যা সাফা করে দিয়েছে, সেই চোর ছেচ্চরগুলোকে লাল কার্পেট সম্বর্ধণা দিয়ে ফেরৎ আনা। দুই নাম্বার উইন্ডোজে এক নাম্বার লেটেস্ট ব্রাউজার আর মিডিয়া প্লেয়ার ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক কিছুই করতে হয়েছে দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে। যাইহোক, ভাগ্য অতীব সুপ্রসন্ন হলে নাকি অতলান্তিকেও চর দেখা দেয়। আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো না। ঊনচল্লিশ মিনিট রিমেইনিং নামক সাইনবোর্ডটা দীর্ঘ দু'ঘন্টা ধরে মনিটর জুড়ে ঝুলানো দেখে বুঝলাম কাজ হবে না। এরে ধরি, ও ভাই তোমার এক্সপি আছে? উত্তর আসে, পিসিই নাই- এক্সপি দিয়া কী করুম? আরেকজনরে জিজ্ঞেস করি, ভাব নিয়ে উত্তর দেয় ভিসতা ইউজ করি! আমি পড়লাম না মহা গ্যাড়াকলে!

অবশেষে, ৩২ বিটের প্রসেসর আর ৫১২ র‌‌্যাম নিয়ে একটা রিস্ক নিয়েই ফেললাম। দিলাম ভিসতার হোম এডিশন ঢুকিয়ে শালার ভেতরে। এই ভিসতা যোগার হলো এখ বিরাট ইতিহাস নিয়ে। সংক্ষেপে বলে রাখি, পুরা ফাঁকতালে পাইছি, তাও জেনুইন। একেবারে সাইনবোর্ড টানানো।

এখন, পিসিতো দুইদিন পর স্টার্ট করা গেলো কিন্তু নেটে আর ঢুকা যায় না। ঐ দিকে সাদাত অমিত তারেক লাঠি নিয়ে স্বপ্নে তাড়া করে! ডরের চোটে না ঘুমিয়ে রাত কাটাই। নেটে যাওয়াটা ফরযে ক্বেফায়া হয়ে দাড়ায়। এক্সপি'র নেটগীয়ার ভিসতায় কাজ করে না। যাদের নেট ব্যবহার করি, শালারা চৌদ্দটা থেকে বিশটা পর্যন্ত দপ্তর খোলা রাখে। চৌদ্দটা বাজতে বাজতে আমার নিজের ধৈর্য্য ঘড়ির ব্যাটারী শেষ হওয়ার পথে। সলুশন পেলাম, আমার ইমেইল একটা লিংক পাঠানো হলো। সেখান থেকে ড্রাইভার ইনস্টল করে নিলেই হলো। আমি হাসলাম। যে আমি গত আড়াই দিন ধরে নেট সেবা পাইনা তার কাছে পাঠানো হয়েছে ইমেইল, 'ব্যাটা ইতর কোথাকার'। ইতর কথাটার মানে না বুঝে ব্যাটা বলে, "ভি বিটে!" আমি বলি কিছু না, ডাংকে।

কিচেনে গিয়ে আমার সিগারেট মেইট চান্দুকে জিজ্ঞেস করলাম নেট আছে কী না। কয় কাজ করে না। সুন্দরী আনিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম খালি মেইল চেক করবো! ছেমরি কয়, "জেয়ার টয়ার!" আমি কই, যা ফোট, মুড়ি খাগা গিয়া!

ড্রাইভার ইনস্টলড হলো। শত্তুরের মুখে পুরা ছাইয়ের স্তুপ ছড়িয়ে দিয়ে আমার নেট আবার আগের অবস্থানে ফিরে এলো। কিন্তু ঝামেলা বাধালো বত্রিশ বিট। একটা ব্রাউজার খুললেই হার্ডড্রাইভের বাতি আর নিভে না। ভাবে মনে হয় এই ব্যাটা টুয়েন্টিফোর-সেভেন সার্ভিস দেবার জন্য জানপ্রাণ! কী আর করা, এক ক্লিক করে আধা ঘন্টার একটা ঘুম দিয়ে উঠে তারপর ক্লিকের ফলাফল দেখতে পারি। মন্দ না। যাত্রা দেখার সাথে কলা বেঁচাও হয়ে যাচ্ছে আমার।

আমার স্কুল বেলায় সারাংশ লিখনে ফাঁকিবাজি এখন টেরপাই হাতেনাতে। পিসি খারাপ হইলো, এই ঘটনা লিখতে গিয়ে পুরা এক মহাকাব্য লিখে ফেললাম। এখন আমি সেই ঘটনাটা লেখি কেমনে? আরে ঐ যে সেদিন ট্রেনে কানে মোবাইলের তার ঠেসে ধরে গান শুনছিলাম যে। তারপর যে একটা কল এলো, আমার মোবাইলে সারাক্ষণই বীপ করা থাকে। সাধারণত কেউ বুঝেনা আমার কল এসেছে। এবারো তাই হলো। আমি বাইরের কন্ট্রোল থেকে রিসিভ করে কথা বলছি। ঠিক সামনে বসেছিলো দজন শুলারিন। একজন আবার দেখতে সেইরম। (আমি যে কেন শুলার হৈলাম না, আফসোস লাগে ) আমি যখন কথা শুরু করলাম ফোনে, সেইরম চেহারাধারী শুলারিন ললনার চোখের সঙ্গে টু টাইমস নাইনটি ডিগ্রী এঙ্গেল। ললনা আমাকে জিজ্ঞেস করে তাকে কিছু বলছি কিনা। আমি কোনো শব্দ না করে, তার দিকে তাকিয়ে ফোনে কথা চালিয়ে যাই। মেয়েটা জবাব দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ভাষাগত অর্থোদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে ক্ষ্যান্ত দেয়। এবার আমি আস্তে করে মাথা ঝাঁকিয়ে ঠোঁট নেড়ে বুঝাই তোমাকে না, মোবাইলে কথা বলি। মেয়েটা হাসিতে ভেঙে পড়ে, মদন হওয়ার আনন্দে। দুজনেই হাসে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। ফোনে কথা শেষ করে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমিও হাসি। ওদের মতো না। আমার মতো। তা দেখে তারাও হাসে। আমি খুশী হই। যাত্রা ভালো লাগে। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। নেমে যায় সুন্দর সেই ললনা। আমি আবারও বিষাদে ডুবে যাই। নীল নয়নার ফাঁদে অল্পের জন্য পড়া হলোনা বলে আফসোস হয় বাকিটা পথ!

Thursday, April 03, 2008

আজ মন খারাপ করা দিন

আসাম ব্লেণ্ডের টি-ব্যাগ, ওয়াটার কুকারে টগবগ করে ফুটতে থাকা পানি, পাশে কি জানি একটা বিদঘুটে নামের কনডেন্সড মিল্কের টেট্রাপ্যাক। খুঁজে পেতে চা খাওয়ার মগটা বের করা গেলেও চিনির কৌটাটা কেনো যেনো আমার সঙ্গে 'লুকোচুরি' খেলছে। সব হাতের কাছে থাকার পরেও তাই চিনি ছাড়াই চা মুখে তুলতে হচ্ছে।

আমার চা খাওয়া নিয়ে কতোজনই কতো কথা বলে। সর্বশেষ যে কথাটা যোগ হয়েছে তা হলো, আমি নাকি চা খাই-ই চিনি খাওয়া হবে তাই। চিনিহীন চা গলায় ঢালতে ঢালতে টলতে থাকা পায়ে কম্পুর সামনে এসে বসি। একে একে সবগুলো মেসেঞ্জারে লগইন করি, মেইল গুলো খুলে বসি। উঁহু, সব ফকফকা। নতুন কিছু নেই। গত বিশ দিনে সাহারায় হঠাৎ বয়ে যাওয়া সামান্য মরুবাতাসের মতো কেবল একটা মেইলই জ্বলজ্বল করে আসছে। আরএসভিপি ডট কম ডট এইউ থেকে। অকাজের মেইল, জঞ্জালবাক্সে যাবার কথা থাকলেও মেইলটাকে খুলি, প্রতিটা লাইন পড়ি তারপর আবার 'আনরেড' করে রেখে দিই। পরেরবার একই কাজ করি। করছি গত বিশ দিন ধরেই। মেইলটার প্রতিটা শব্দ মুখস্থ হয়ে গেছে। আচ্ছা মুখটা তিতা লাগছে কেনো? আসাম ব্লেন্ডের জন্য! শালার চিনির কৌটা!

এরএসভিপি'র উচ্চারণটা কী! সিলভোপ্লে!! মানে কি দয়াকরুন!
- কে দয়া করবে?

: কে আবার, তনয়া!

- তনয়া, তনয়া কে?

: এহ্, ন্যাকামো করো? তুমি চেন না কে তনয়া?

- সত্যি বলছি, চিনি না। আমার কি তাকে চেনার কথা?

: নয়তো কি? এতোগুলো বছর তার সঙ্গ নিয়ে পার করেছো...!

- আমি পার করেছি তনয়ার সঙ্গ নিয়ে? কি বলছো যা-তা!

: আশ্চর্য! যা-তা বলবো কেনো? তোমার মনে নেই নাকি মনে করতে চাচ্ছো না! ভয় পাচ্ছো, তুমি একটা ভীতু। তুমি কষ্টকে ভয় পাও। তনয়াকে মনে করলে তুমি কষ্ট পাবে, তাই মনে করতে চাইছো না।

- আমি ভীতু না। আমি কোনো তনয়াকে চিনি না। যাকে চিনি না তাকে মনে করে কষ্ট পাবো কেনো!

: তুমি নিজের সঙ্গেই মিথ্যে বলছো।

- মিথ্যে বলবো কেনো? সত্যি বললেই বা তুমি কি ক্ষতি করবে!

: সত্যি বা মিথ্যে- আমি কোনোভাবেই তোমার ক্ষতি করতে পারবো না। আমি তো তুমিই! আমি কেবল তোমার ভুলটা ধরিয়ে দিতে পারবো।

- লাগবে না তোমার ভুল ধরাতে। তুমি যাও। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

: আরেকটু থাকি? এটা একটা প্লীজ!

- থাকতে পারো। কিন্তু তনয়া ফনয়া নিয়ে কথা বলতে পারবে না।

: আচ্ছা ঠিকাছে। চলো তাহলে অন্যকিছু নিয়ে কথা বলি। আচ্ছা তোমার কি সে জায়গাটার কথা মনে আছে? ঐযে অনেক বিস্তীর্ণ হলুদ রঙের মাঝে হঠাৎ বয়ে চলা একটা সরু সাগর...!

- কোন জায়গার কথা বলছো? সাগর আবার সরু হয় কী করে! এমন কোনো আজগুবি জায়গা কি আমার চেনার কথা!

: আশ্চর্য! এটাতো তোমারই প্রিয় জায়গা। তুমি আমাকে জায়গাটার গল্প বলেছো এই সেদিনও। মনে নেই তোমার!

- একদমই মনে পড়ছে না। তুমি কি আমাকে বলবে জায়গাটার কথা!

: আমিতো বলতেই চাই। ঐযে একটা পায়ে চলা সাদা মেঠো পথ। বাহাদুরপুরের কালীবাড়ির বটগাছটার মতো একটা বুড়ো বটগাছ, তার পাশ দিয়ে বেঁকে নেমে গেছে পথটা সরু হয়ে। যেতে যেতে পথটা ক্ষেতের আল হয়ে যায়। অনেকদূর হেঁটে গেলে হলুদ শর্ষে ক্ষেত। যতদূর চোখ যায় কেবল হলুদ আর হলুদ। সেখানে একটা সাগর। খালের মতো সরু। ঘাসময় ঢালু পাড়ে পা ছড়িয়ে বসলে বিছানো হলদে চাদর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। সামনে দিয়ে দুয়েকটা ভটভটি জাহাজ পাল উঁচিয়ে চলে যায়। সেখানে সূর্যের তেজ কম, মৃদু বাতাস বয়, তাতে চামেলীর গন্ধ। তুমি সেখানে বসে থাকো। তোমার পাশে বসে থাকে তনয়া। তোমার হাতে হাত রেখে, তোমার কাঁধে মাথা রেখে....।

- থামো থামো। এমন কোনো জায়গার কথাই তো আমি মনে করতে পারি না। আমি কখনোই এমন একটা জায়গায় যাইনি, তোমাকে গল্প বলবো কোত্থেকে! আমি নিজেই যেখানে যাইনি, সেখানে তনয়া নামের অস্তিত্ব কোথায় পাও তুমি বলতো! আমিতো এই নামে কাউকে মনেই করতে পারছি না!

: তুমি মনে করতে চাচ্ছোনা বলে পারছো না। আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও, তোমাকে তনয়ার গল্প বলি। তুমি মনে করতে পারবে সব। তার হাতভর্তি রেশমি চুড়ি, সে তনয়া। কোমরসমান লম্বা চুল, সে তনয়া। চোখ নাচিয়ে হাসে খিলখিল করে, এক পায়ে পরা নুপুরের কেমন অদ্ভুত শব্দ তুলে দৌড়ে যায় শর্ষে ক্ষেতের আল ধরে, সে-ই তো তনয়া। শুনবে তুমি, শুনবে তনয়ার গল্প?

- না না, আমার এখন সময় নেই। তুমি যাওতো এখন। তনয়ার গল্প শোনার চেয়ে আমার এখন বেরিয়ে পড়া জরুরী। কাজে দেরী হয়ে যাবে নয়তো...!

Tuesday, March 25, 2008

আক্ষেপ-

১.
প্রথম ট্রেনে চড়ি সেই বাচ্চাবেলায়। বড় হবার আগে সেই রুটটাই উঠে যায়। ট্রেনের অপেক্ষায় বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দুই পাটের ক্রিম মাখানো বিস্কুটের স্বাদ চাখা হয়ে ওঠেনি তারপর আর।

বড়বেলার উপবনের সেই যাত্রাটুকু আর পাওয়া হবে না। চকিত অভিযান শেষে ফেরার পথে প্রচন্ড আবেগে বাড়ানো হাতটা অস্পর্শিতই থেকে যাবে অনাদিকাল। আকষ্মিকতা কিংবা অন্য চিন্তায়, বাড়িয়ে ধরা ভাজ করা ফিনফিনে ওড়নাটা ছুঁয়ে দেখবোনা কখনোই।

সিলেট গিয়েছি আগে। ভবিষ্যতেও যাবো হয়তো! বিশদ চর্বন চলবে যাত্রার, কেবল মনের চিলে কোঠা থেকে বের হয়ে বর্ণগাঁথা হবে না সংক্ষিপ্ত মধুর সে ঘটনার!

২.
"ফ্রো ভাইনাখটেন" - ইস্টারের সময়ে ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা-সম্বোধনে সৃষ্ট প্রশ্নবোধকে ডানিয়েলা তুষারপাতকে নির্দেশ করে। বড্ড বেশী ভুল সময়ে হয়ে গেলো! জানালার সার্শী গলে সাদা ক্যানভাসে চোখ রেখে মুঠোফোনে আলাপ সারি। পেঁজা তুলোর বর্ষণের নিচে হাত ধরে হাঁটা হবে না প্রিয় মানুষটির সাথে। ভুল সময়ে হয়তো ভুল মানুষটিই আপন হয়ে উঠবে কখনো!

৩.
তিব্বতের ঘটনায় চীনের হিংস্রতার খবর টিভি জুড়ে। অলিম্পিকের মতো অনুষ্ঠান বর্জন করা এতো সহজ না! আমি ক্ষুদেমানব, আইওসি'র দাওয়াতনামাটা প্রত্যাখানের অধিকার আমার গণতান্ত্রিক। পরপর চারবার বিশ্বঅলিম্পিকের আয়োজকদের সঙ্গে কাজ করার স্বপ্নের বিনিময়ে তিব্বতে শান্তি ফিরে আসুক, কামনা করি!

Friday, March 14, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০৪

: আলেস ক্লা আন্নে?

: ইয়া... আলেস গুটে। দু বিস্ত জেয়ার ডুন গেভোর্ডেন!

মৎস্য আর ঘাস পাতার ওপর গাঁইতি চালিয়ে, বুকের দুরফুর কমানোর লক্ষ্যে গরু খাওয়া বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিলো। আল্টস্টাডে ডরোথীন স্ট্রাসের মুস্তাফার দোকানে তাই হানাও দেয়া হয়নি এই মাসখানেক। কাল বিকেলে কারস্টাডের উপরের তলার ক্যাফেটেরিয়াতে উইণ্ডো সীটে বৃষ্টিস্নাত শহরের বিষণ্ণতায় এক গ্লাস আমরস গলাধঃকরণ করেই এলোমেলো পদক্ষেপে পুরাতন শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মাসখানেকের বিরতির পর গরুর হাম্বা ডাক আমাকে খুব নস্টালজিক করে দিচ্ছিলো। বৃহষ্পতিবার মুস্তাফা ফ্রেশ গোশত দোকানে তোলে। দেখিই না গিয়ে কী হয়!

মুস্তাফার মা। ষাটোর্ধ তুর্কিশ মহিলা। দাঁতহীন বুড়ো মানুষের মতো কথা বলেন। খুব ভালো জার্মান হয়তো বলেন না, কিন্তু কথা বলেন খুব মায়া করে। তুর্কী আন্নে মানে হলো, মা। আমি দোকানে ঢুকেই ভদ্রমহিলাকে ঐভাবে সম্বোধন করি। কুশল জিজ্ঞেস করি। ভদ্রমহিলা অনেক খুশী হোন।

মুস্তাফা সুন্দর, ভালো, তরতাজা দেখে গোশত নিয়ে কেটে কুটে কয়েকটা ঠোঙা করে দেয়। ও ভালো করেই জানে, ওসব কাটাকুটি আমাকে দিয়ে হয় না, নিজেই সব রেডি করে দিয়ে বলে, "নাও, এবার শুধু হাঁড়িতে তোলা বাকী!"

আমি শত-কোটি ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে তড়িঘড়ি করে রাস্তায় নেমে আসি। ঠিক পরক্ষণেই হৃদয়ের উষ্ণ ছোঁয়াটুকু ভুলে যাই। ট্রাম ধরার চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এবং দ্রুত পা চালাই, ট্রামটা মিস হলে আরও পাঁচটা মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে!

কাউফহফে দেখা হয়ে যায় নাদিয়া'র সঙ্গে। ম্যানস্ সেকশনে কাজ করে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় খেয়াল করি কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চশমা না থাকায় ঠাহর করতে পারি না ঠিক। খুব ধীরে সেদিকে এগোই একটা-দুটো শার্ট-গ্যাঞ্জি নেড়ে নেড়ে। কাছে যেতেই নাদিয়া হাউমাউ করে ওঠে।

"মাই গট। তোমার একী হাল! কি এতো টেনশন করো! ম্যান তোমাকে চেনাই যায় না। তুমি কি ঠিক আছো?"

নাদিয়াকে আশ্বস্ত করি। আমি ঠিকই আছি। শুধু স্ট্রেসের পরিমানটা বেড়েছে। নিজের প্রতি যত্ন বলতে যা বুঝায়, ওটাতে সামান্য ঘাটতি হচ্ছে বটে! সেটা ঠিকমতো হলেই আবার ফুলে ফেঁপে ওঠা যাবে, ব্যাপার না।

কিছু সময় কাটলো নানা আলাপে। নাদিয়া দৌঁড়ে গেলো ক্যাশে ডাক পরেছে বলে। আমি পাশ কাটিয়ে এসকেলেটর ধরে সোজা নিচের ফ্লোরে। নাদিয়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করে না।

কাউফহফ থেকে যখন বেরুলাম তখন আকাশে চালুনীর মতো ফুঁটো। চালের গুঁড়ি যেমন খুব সূ্ক্ষ হয়ে পরে, তেমনি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে- পটপটকটকট! বেথোফেনের মূর্তির পাশ দিয়ে স্টারবাকস, পিৎজা হাট ছাড়িয়ে ফ্রিডেন প্লাৎস। ডিএম-এ ঢুকতে হবে। কিছু দরকারী জিনিষ না কিনলেই না। অযথাই কয়েকটা পাক ঘুরে তিনটা মাত্র জিনিষ হাতে ধরে চেকআউটে বিল মিটিয়ে বের হবার পথেই ঝপাৎ করে নেমে গেলো। অনেকের মতো ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করলোনা বলেই সোজা হাঁটা দিলাম মার্কটপ্লাৎসের দিকে। ওখান থেকে ক্যাফে গোয়েটলিশ, বুভিয়ের, কার্টহাউজ পেরিয়ে বহুমূখি বাস স্ট্যান্ড।

লাইনের বাস এলো পনেরো মিনিট পর। উঠলাম। দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। সামনের দিকে কোনমতে নিজের ভারসাম্য রক্ষা হয় এমন একটা জায়গায় ঠেস দিলাম। পাশের সীটেই এক বয়স্ক মহিলা তার কুকুর নিয়ে বসে আছেন। ভাবছি, কুকুরটা যদি আমাকে কামড়ে দেয়, তাহলে!

আমার ঠিক সামনে নব্বই ডিগ্রী কৌণিক ভঙিতে দাঁড়িয়ে আছে এক ললনা। খুব সম্ভবত পোলিশ হবে। শরীরের গঠনে তাই মনে হয়। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

আমার এখন জানালার কাঁচে এঁকেবেঁকে বৃষ্টির গড়িয়ে পড়া পানি দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু সমস্যা হলো জানালাটা দেখতে হলে ললনাটির ঠোঁট সমান উচ্চতায় আমাকে তাকাতে হয়। বাদ দিলাম। কারণ, আমার বাম পাশের যে ভদ্রলোক আছেন তিনি মনে করছেন আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ললনাটিকে দেখছি। তার দিকে না তাকিয়েও আমার দিকে তার দৃষ্টি বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছিলো আমাকে।