Tuesday, March 25, 2008

আক্ষেপ-

১.
প্রথম ট্রেনে চড়ি সেই বাচ্চাবেলায়। বড় হবার আগে সেই রুটটাই উঠে যায়। ট্রেনের অপেক্ষায় বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দুই পাটের ক্রিম মাখানো বিস্কুটের স্বাদ চাখা হয়ে ওঠেনি তারপর আর।

বড়বেলার উপবনের সেই যাত্রাটুকু আর পাওয়া হবে না। চকিত অভিযান শেষে ফেরার পথে প্রচন্ড আবেগে বাড়ানো হাতটা অস্পর্শিতই থেকে যাবে অনাদিকাল। আকষ্মিকতা কিংবা অন্য চিন্তায়, বাড়িয়ে ধরা ভাজ করা ফিনফিনে ওড়নাটা ছুঁয়ে দেখবোনা কখনোই।

সিলেট গিয়েছি আগে। ভবিষ্যতেও যাবো হয়তো! বিশদ চর্বন চলবে যাত্রার, কেবল মনের চিলে কোঠা থেকে বের হয়ে বর্ণগাঁথা হবে না সংক্ষিপ্ত মধুর সে ঘটনার!

২.
"ফ্রো ভাইনাখটেন" - ইস্টারের সময়ে ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা-সম্বোধনে সৃষ্ট প্রশ্নবোধকে ডানিয়েলা তুষারপাতকে নির্দেশ করে। বড্ড বেশী ভুল সময়ে হয়ে গেলো! জানালার সার্শী গলে সাদা ক্যানভাসে চোখ রেখে মুঠোফোনে আলাপ সারি। পেঁজা তুলোর বর্ষণের নিচে হাত ধরে হাঁটা হবে না প্রিয় মানুষটির সাথে। ভুল সময়ে হয়তো ভুল মানুষটিই আপন হয়ে উঠবে কখনো!

৩.
তিব্বতের ঘটনায় চীনের হিংস্রতার খবর টিভি জুড়ে। অলিম্পিকের মতো অনুষ্ঠান বর্জন করা এতো সহজ না! আমি ক্ষুদেমানব, আইওসি'র দাওয়াতনামাটা প্রত্যাখানের অধিকার আমার গণতান্ত্রিক। পরপর চারবার বিশ্বঅলিম্পিকের আয়োজকদের সঙ্গে কাজ করার স্বপ্নের বিনিময়ে তিব্বতে শান্তি ফিরে আসুক, কামনা করি!

Friday, March 14, 2008

গুরুচন্ডালী - ০০৪

: আলেস ক্লা আন্নে?

: ইয়া... আলেস গুটে। দু বিস্ত জেয়ার ডুন গেভোর্ডেন!

মৎস্য আর ঘাস পাতার ওপর গাঁইতি চালিয়ে, বুকের দুরফুর কমানোর লক্ষ্যে গরু খাওয়া বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিলো। আল্টস্টাডে ডরোথীন স্ট্রাসের মুস্তাফার দোকানে তাই হানাও দেয়া হয়নি এই মাসখানেক। কাল বিকেলে কারস্টাডের উপরের তলার ক্যাফেটেরিয়াতে উইণ্ডো সীটে বৃষ্টিস্নাত শহরের বিষণ্ণতায় এক গ্লাস আমরস গলাধঃকরণ করেই এলোমেলো পদক্ষেপে পুরাতন শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মাসখানেকের বিরতির পর গরুর হাম্বা ডাক আমাকে খুব নস্টালজিক করে দিচ্ছিলো। বৃহষ্পতিবার মুস্তাফা ফ্রেশ গোশত দোকানে তোলে। দেখিই না গিয়ে কী হয়!

মুস্তাফার মা। ষাটোর্ধ তুর্কিশ মহিলা। দাঁতহীন বুড়ো মানুষের মতো কথা বলেন। খুব ভালো জার্মান হয়তো বলেন না, কিন্তু কথা বলেন খুব মায়া করে। তুর্কী আন্নে মানে হলো, মা। আমি দোকানে ঢুকেই ভদ্রমহিলাকে ঐভাবে সম্বোধন করি। কুশল জিজ্ঞেস করি। ভদ্রমহিলা অনেক খুশী হোন।

মুস্তাফা সুন্দর, ভালো, তরতাজা দেখে গোশত নিয়ে কেটে কুটে কয়েকটা ঠোঙা করে দেয়। ও ভালো করেই জানে, ওসব কাটাকুটি আমাকে দিয়ে হয় না, নিজেই সব রেডি করে দিয়ে বলে, "নাও, এবার শুধু হাঁড়িতে তোলা বাকী!"

আমি শত-কোটি ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে তড়িঘড়ি করে রাস্তায় নেমে আসি। ঠিক পরক্ষণেই হৃদয়ের উষ্ণ ছোঁয়াটুকু ভুলে যাই। ট্রাম ধরার চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এবং দ্রুত পা চালাই, ট্রামটা মিস হলে আরও পাঁচটা মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে!

কাউফহফে দেখা হয়ে যায় নাদিয়া'র সঙ্গে। ম্যানস্ সেকশনে কাজ করে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় খেয়াল করি কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চশমা না থাকায় ঠাহর করতে পারি না ঠিক। খুব ধীরে সেদিকে এগোই একটা-দুটো শার্ট-গ্যাঞ্জি নেড়ে নেড়ে। কাছে যেতেই নাদিয়া হাউমাউ করে ওঠে।

"মাই গট। তোমার একী হাল! কি এতো টেনশন করো! ম্যান তোমাকে চেনাই যায় না। তুমি কি ঠিক আছো?"

নাদিয়াকে আশ্বস্ত করি। আমি ঠিকই আছি। শুধু স্ট্রেসের পরিমানটা বেড়েছে। নিজের প্রতি যত্ন বলতে যা বুঝায়, ওটাতে সামান্য ঘাটতি হচ্ছে বটে! সেটা ঠিকমতো হলেই আবার ফুলে ফেঁপে ওঠা যাবে, ব্যাপার না।

কিছু সময় কাটলো নানা আলাপে। নাদিয়া দৌঁড়ে গেলো ক্যাশে ডাক পরেছে বলে। আমি পাশ কাটিয়ে এসকেলেটর ধরে সোজা নিচের ফ্লোরে। নাদিয়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করে না।

কাউফহফ থেকে যখন বেরুলাম তখন আকাশে চালুনীর মতো ফুঁটো। চালের গুঁড়ি যেমন খুব সূ্ক্ষ হয়ে পরে, তেমনি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে- পটপটকটকট! বেথোফেনের মূর্তির পাশ দিয়ে স্টারবাকস, পিৎজা হাট ছাড়িয়ে ফ্রিডেন প্লাৎস। ডিএম-এ ঢুকতে হবে। কিছু দরকারী জিনিষ না কিনলেই না। অযথাই কয়েকটা পাক ঘুরে তিনটা মাত্র জিনিষ হাতে ধরে চেকআউটে বিল মিটিয়ে বের হবার পথেই ঝপাৎ করে নেমে গেলো। অনেকের মতো ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করলোনা বলেই সোজা হাঁটা দিলাম মার্কটপ্লাৎসের দিকে। ওখান থেকে ক্যাফে গোয়েটলিশ, বুভিয়ের, কার্টহাউজ পেরিয়ে বহুমূখি বাস স্ট্যান্ড।

লাইনের বাস এলো পনেরো মিনিট পর। উঠলাম। দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। সামনের দিকে কোনমতে নিজের ভারসাম্য রক্ষা হয় এমন একটা জায়গায় ঠেস দিলাম। পাশের সীটেই এক বয়স্ক মহিলা তার কুকুর নিয়ে বসে আছেন। ভাবছি, কুকুরটা যদি আমাকে কামড়ে দেয়, তাহলে!

আমার ঠিক সামনে নব্বই ডিগ্রী কৌণিক ভঙিতে দাঁড়িয়ে আছে এক ললনা। খুব সম্ভবত পোলিশ হবে। শরীরের গঠনে তাই মনে হয়। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

আমার এখন জানালার কাঁচে এঁকেবেঁকে বৃষ্টির গড়িয়ে পড়া পানি দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু সমস্যা হলো জানালাটা দেখতে হলে ললনাটির ঠোঁট সমান উচ্চতায় আমাকে তাকাতে হয়। বাদ দিলাম। কারণ, আমার বাম পাশের যে ভদ্রলোক আছেন তিনি মনে করছেন আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ললনাটিকে দেখছি। তার দিকে না তাকিয়েও আমার দিকে তার দৃষ্টি বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছিলো আমাকে।