Friday, June 27, 2008

স্বপ্নযাত্রা

: হিথ্রো বাউন্ড!
: ইয়েস এন্ড মে আই রিকোয়েস্ট ফর এ উইন্ডোসীট প্লীজ!
: স্যরি স্যার, অল আর গন। হাউ এবাউট এ নাইস আইল ওয়ান ইনস্টেড!
: ইটস নট মাই চয়েস, বাট ইয়েস প্লীজ।
: এক্সট্রিমলী স্যরি, বাট ইউ আর...
: ইয়েস আই নো। আইল সীট ইজ ফাইন, থ্যাংক্স।

বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে পৌঁছুতে দেরী হয়ে যাওয়ায় চড়ে থাকা মেজাজটা আরেকটু চড়ে যায় প্লাস্টিক হাসি ঝুলানো গোলগাল মুখের তরুণীর কাঠখোট্টা আসন বিন্যাসের ধরণ ধরণ দেখে। জানালার ধারে বসে কয়েক পাত্তর ১৯৯২ সালের দ্রাক্ষারস গলায় চালান করে আয়েশ করে এলিয়ে থাকাটা বোধহয় হচ্ছেনা এবার! অনবরত পাশ দিয়ে কারও না কারও চলাফেরার কারণে সৃষ্ট বিরক্তি এড়াতে আইল সীটটা অপছন্দের খাতায় রয়ে গেছে সবসময়। কেউ হয়তো আকাশে ওঠার আধাঘন্টার মধ্যেই টয়লেটে যাবার বায়না ধরে বসে কিংবা পাশ দিয়ে একটু পরপর ঘটঘট করে একেকজন হোস্টেস বিপুল বিক্রমে হেঁটে যায়, কখনো তাদের সঙ্গে ঘরঘর শব্দ তুলে যায় মালগাড়ি। আর ফেরিওয়ালার মতো বিরক্তিকর একই শব্দের ঘ্যানঘ্যানি তো আছেই!

কাস্টমস, নিরাপত্তা সব পেরিয়ে বিরক্তিকর সোয়া ঘন্টার এক কপাল কুঁচকানো যাত্রা শেষে আবার কানেক্টিংএর ঝামেলা। সাড়ে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করাটাও বিরক্তিকর। বিশাল হিথ্রোর এমাথা-ওমাথা করা যায় বটে! হাতে বহনযোগ্য তেমন কিছু না থাকায় হেঁটে বেড়ানোটাই প্রাধান্য পেলো কোথাও সটান-নির্জীব বসে থাকার চেয়ে। আগে কখনো হিথ্রো দেখা হয়নি। গল্পই শোনা হয়েছে কেবল। বেশ লম্বা একটা জায়গা ধরে হাঁটতে গিয়ে মনে হলো এখানেই হয়তো চৌদ্দ বছর আগে ভাগ্নে জেদ ধরে দৌড় লাগিয়েছিলো এলোপাথারি। বাবা তার পিছুপিছু। দৌড় শেষ করে ক্লান্ত পুঁচকে ভাগ্নে আর পায়ে হেঁটে আসার শক্তি পায় নি। তাকে আসতে হয়েছে বাবার হাতে ঠেলা লাগেজ ট্রলীতে! দৃশ্যটা কল্পনায় আসতেই কপালের কুঁচকানো ভাবটা নিমিষে দূর হয়ে যায়। ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসির একটা রেখাও বোধহয় ফুটে ওঠে। নানা রকম ডিউটিফ্রী দোকানগুলোতে হাঁটতে হাঁটতে সামান্য ক্লান্তি অনুভূত হয়। সামনের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে একটা ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দেওয়া যাক তাহলে এবার।

ইংলিশরা কথা বলে পেটের ভেতর অর্ধেক রেখে, আইরিশরা আরও মারাত্বক! ভালো করে কান পেতে না শুনলে প্রাত্যহিক ইংরেজী ব্যবহার না করা যে কারও পক্ষেই ভাবোদ্ধার করা দুরূহ। ক্যাফেটেরিয়ার আইরিশ মেয়েটা দেখতে অপার্থিব হলেও কথা বলে গড মাস্ট বি ক্রেজী'র কালাহারীর সেই কালো মানুষটার মতো। যে কথা বললে মনে হয় পাখি কিচিরমিচির করছে, তার নিজস্ব ভাষায়! অপার্থিব সুন্দরী, পাখির কলতান- উপমাটা তাহলে নেহায়েতই মন্দ হয়নি। বরং একটা স্নিগ্ধতা ছড়ানো ব্যাপার আছে পুরো উপমায়। কফির স্বাদও খারাপ না। দশে সাড়ে ছয় দেয়া যায়। ফার্স্ট ডিভিশন মার্ক। এখনকার জিপিএ সিস্টেমে কতো হয় কে জানে!

কফিতে তৃতীয় দফা চুমুক দিতে গিয়ে চড়কীর মতো ঘুরতে থাকা চোখে যে জিনিষটা আটকে যায় সেটা সুরুৎ করে নিয়ে যায় বহু বছর আগের এক ঘটনায়। সুমনা, ডেনিম জিন্স আর কালো ফতুয়াতে । তখন সতেরোতে থাকা সুমনার সঙ্গে টক-ঝাল-মিস্টি এক সম্পর্ক। সময়ের স্রোতে সম্পর্কের আচার থেকে টক আর ঝাল জিনিষগুলো ঝরে যায়। তবে মিষ্ট ভাবটা বেশিদিন টিকেনি। সেখানে সামান্য পরিমান তেঁতো যোগ হয়ে যায় কী করে যেনো। হয়তো দূরত্ব, হয়তো অন্য কিছুর কারণে! মিষ্ট-তেঁতো সম্পর্কটা ধ্বসে পড়েছিলো আধাযুগ পরে। পুরো নিশ্চিহ্ন হয়ে হয়তো যায় নি, হয়তো ধ্বংসাবশেষ কিছুটা রয়ে গিয়েছিলো, দাঁড়িয়ে ছিলো ধুঁকে ধুঁকে। সম্পর্কের ধ্বংসাবশেষে যেনো কখনো মোলায়েম হাতের ছোঁয়া গভীর ক্ষত তৈরী করতে না পারে, সেজন্য স্মৃতিকোটরের সেই দরজাগুলো চিরতরে সিলগালা করে দেয়া হয়েছিলো। আর খোলা হয়নি, এতোগুলো বছরেও, দেখা হয়নি কতোটা সৃতির ধূলা পড়লো সেই ভগ্নাংশের ওপর! কতোশত ইচ্ছা ছিলো, স্বপ্ন ছিলো, আকাংখা ছিলো। আটলান্টিকের বিশাল জলরাশি তার সবকিছুই নিয়ে নিয়েছে নিজের বুকে। একটু ক্ষণের দেখা হওয়ার আকুতি ছিলো। নাটকীয়ভাবে দেখা হওয়া বিমান যাত্রায় একসঙ্গে বাকী পথ পাড়ি দেবার কথা ছিলো, ফেরার কথা ছিলো একই সঙ্গে। হাত ধরে খানিকটা সময় চুপচাপ বসে থাকা হয়নি সমস্ত কোলাহল উপেক্ষা করে। কাঁধে মাথা রেখে চুপটি করে ঝিম মেরে থাকার কথা ছিলো কতোবার। কিছুই হয়নি। সময় চলে গেছে সুমনাকে সঙ্গে করে। পথের সেই বাঁকে, ফিরে এসে যেখানে সুমনাকে পাবার কথা ছিলো, মাঝে মাঝেই দূর থেকে চোখ বুলানো হয়। বাঁকটা এখনো রয়ে গেছে সেরকম। সময়ের মরচে ধরেনি আদৌ। কখনো সখনো মৃদু বাতাসে কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে যায় পথের সে বাঁক ধরে। শুধু সময়টাকে বাহন করে সেই বাঁকে আর উড়ে ফেরা হয়না কারোই, কখনোই!

হ্যালুসিনেশন! এই সময়ে, এখানে সুমনার থাকার কথা না। আর যাকে গত বহু বছরে একবারও দেখা হয়নি, তাকে এক পলকে দেখে একবারেই চিনে ফেলাটা কিছুটা অসম্ভবই। অতএব সমীকরণ মেলানো হলো, "সুমনা এই মুহূর্তে এখানে নেই!"

কফি ঠান্ডা হয়ে জমে গেছে সেই কখন। ঠান্ডা কফি খেতেও অবশ্য আলাদা একটা থ্রীল আছে। আইরিশ তরুণীর কলতান আরেকবার শোনার আগে বরং এই থ্রীলটাই গলাধঃকরণ হোক আগে।

অল প্যাসেঞ্জার অফ বিএ-জিরো ওয়ান ফোর ফাইভ, টু ডাক্কা আর রিকোয়েস্টেড টু প্রোসীড... ৪ নাম্বার টার্মিনালের সবগুলো স্পীকার কাঁপানো ঘোষণায় আরেকদফা কপাল কুঁচকানো আগাপাশতলা চেকিং শেষে মাথা ধরানো হাউকাউমুখর কক্ষে প্রায় দশ ঘন্টা ব্যাপী ভ্রমনের মানসিক প্রস্তুতি প্রায় নাগাল ছেড়ে বেরিয়ে যায়, এমন অবস্থা। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় ঠাঁই হলো একদম কোণার দিকের একটা আসনে। ৭৭৭ বোয়িংএ উঠার নাটক মঞ্চায়নের পর্দা উঠতে এখনো বুঝি অনেক দেরী। কানে উপলকে তার "আমি চাই তোমাতে হারাতে" সহ গুঁজে দিয়ে জানালার বাইরে বিশাল এয়ারক্রাফট পরিদর্শনটাই এই মুহূর্তে বুদ্ধিমানের কাজ! আপেক্ষমান সেই কক্ষে মানুষ আসছে-বসছে-দাঁড়াচ্ছে, বসা কেউ দাঁড়াচ্ছে, দাঁড়ানো কেউ হাঁটছে, সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে, হাঁটুক না যার যতো খুশী! কপালটা একটু একটু করে আরও বেশি কুঁচকে যাচ্ছে। কক্ষের আড়াআড়ি একটা আসন থেকে কেউ উঠে সামনে দিয়ে পায়চারীর মতো করে হেঁটে গেলো বারকয়েক। তারপর হঠাৎ থেমে, খানিক ইতস্ততঃ হয়ে জিজ্ঞেস করে, "আপনি, মানে তুমি সম্রাট...!"
সেই পরিচিত কণ্ঠ, কণ্ঠে সেই পরিচিত ঝংকার। দৃষ্টিসীমার ঘুচানো ব্যবধানে সৃষ্ট অস্পষ্টত্ব কাটিয়ে ওঠার পর বুঝা যায়, হ্যালুসিনেশন নয়, এ যে সুমনাই। কতগুলো বছর পর! কপালের ভাজগুলো মুছে যেতে থাকে একএক করে। প্রসন্নতা ফুটে উঠতে থাকে অবয়বে। এতোদিনের বদ্ধকুঠরীর দরজাগুলো একে একে সব সশব্দে খুলে যেতে থাকে যেনো আজ, এই জুনের পড়ন্ত বিকেলে।

: কেমন আছো সু! অনেক শুভেচ্ছা আজকের দিনে তোমাকে।
: মনে রেখেছো তাহলে...।

আরোহন শুরু হয়ে গেছে ততোক্ষণে। এক স্বপ্ন যাত্রার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সম্রাট ভাবে এই স্বপ্নটা সত্যি হলে কী এমন ক্ষতি হয় জগতের!

No comments: