Monday, March 26, 2007

স্বাধীনতা দিবসের স্যালুট :: ঘোষক নিয়ে ক্যাচাল

লেখাটা একই সাথে হাজারদুয়ারীতে প্রকাশিত, যা আজকেই আপ হয়েছে।

========================

স্বাধীনতার 36তম বার্ষিকীতে এসেও যে বিষয় গুলো এখনো মুখরোচক, ঘোষক বিতর্ক তার মধ্যে অন্যতম। এতগুলো দিন অতিবাহিত করার পরেও স্বাধিনতার ঘোষক বিতর্কে এখনো একমত হওয়া গেলো না। স্থান দেয়া গেলো না স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে তাঁর জন্য সংরক্ষিত আসনে, দেওয়া হলো না তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার, অন্যতম মুক্তিসেনানী মেজর জিয়াউর রহমানকে তাঁর যোগ্য সম্মান।

বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে চলেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক ক্ষেত্র এদিক দিয়ে সবচাইতে এগিয়ে। বর্গীদের হানা বন্ধ হলেও তাদের উত্তরসূরীরা কখনোই থেমে ছিলো না এদেশে। ধন-সম্পদের মতো তারা তাদের হাত বাড়িয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকেও। কালো পর্দা দিয়ে দৃষ্টি ঢেঁকে দিয়েছে এদেশের মানুষের, রেখেছে অন্ধকারে। রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস, যে ইতিহাস সত্যকে ধারণ করেনা সে ইতিহাস। স্বাধীনতার নানা ঘটনার সাথে চাপা পরে গেছে "স্বাধীনতার ঘোষক"-এর প্রকৃত নাম।

স্বাধীনতার ঘোষকের কথা বললে সাধারনভাবে যে প্রমান সবাই চোখের সামনে পেতে চায় তা হলো 'দি স্টেটসম্যান' পত্রিকার মার্চ 27, 1971 এর সংখ্যাটি। মি. রহমান-এর উদ্বৃতি দিয়ে প্রকাশ করা ঘোষনাটিকেই ধরা হয় মহান স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষনা। বলাহয় মি, রহমান বলতে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানকেই বুঝিয়েছিলো স্টেটসম্যান। আর তাই মেজর জিয়াউর রহমান হলেন বংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষক।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতা ছিলো খানিকটা ভিন্ন। মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম থেকে প্রথম যে ঘোষনাটা পাঠ করেন (বঙ্গবন্ধুর পক্ষে) তার সময় ছিলো 27 মার্চ সন্ধ্যা 7টা 30 মিনিট। 27 মাচের্র সন্ধ্যায় প্রচারিত ঘোষনাটি 27 তারিখের পত্রিকায় আসাটা কোনভাবেই যুক্তিসিদ্ধ হয় না। তাহলে দি স্টেটসম্যান কোন ঘোষনার কথে উল্লেখ করেছিলো, আর মি, রহমান বলতে তাহলে কাকে বুঝিয়েছিলো?

ইতিহাস বিকৃতির স্বীকার অনেকেই মানতে নারাজ যে 25শে মাচের্র কালো রাতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাতে আটক হবার আগেই আলোচনা ভেস্তে গেলে কি পরিস্থিতি হতে পারে তা আঁচ করেছিলেন এবং তাঁর লিখিত দু'টি ঘোষনার পাশাপাশি নিজের কণ্ঠে একটি মেসেজ তৈরী করেছিলেন যা কিনা 25শে মাচের্র কালো রাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হত্যাজজ্ঞ শুরু হওয়ার পর একটি হ্যান্ডি ট্রান্সমিটারের সাহায্যে প্রচার করা হয়।

এই প্রিরেকর্ডেড মেসেজ এবং হ্যান্ডি ট্রান্সমিটারের বিষয়টি গোঁপন থাকে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং এবং তাঁর খুব কাছের কয়েকজন সিনিয়র সহকর্মীর মাঝে। 25শে মার্চ রাত 11:30 মিনিটে বলধা গার্ডেন থেকে হ্যান্ডি ট্রান্সমিটারের সাহায্যে 'রেডিও পাকিস্তান ঢাকা'-এর ফ্রিকোয়েন্সীর খুব কছাকাছি ফ্রিকোয়েন্সীতে প্রচার করা হয় প্রি-রেকর্ডেড মেসেজটি, যাতে করে যারা যারা রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র শুনবে তারা তখন মেসেজটিও শুনতে পাবে, এই ছিলো উদ্দেশ্য। আর সবচেয়ে বড় যে উদ্দেশ্যটি ছিলো তা হলো ঢাকায় অবস্থানরত সকল দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের এবং আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের কাছে মেসেজটি পৌঁছানো। সে উদ্দেশ্য যে সফল হয়েছিলো তার প্রমান ডেভিড লসাকের 'পাকিস্তান ক্রাইসিস' বইটি। এই মেসেজটিই হচ্ছে মহান স্বাধীনতার ঘোষনা যা বাংলাদেশ ডকুমেন্ট হিসেবে ভারতে সংরক্ষিত আছে এবং যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলিলে রস্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর আমলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তৎকালীন ডেইলী টেলিগ্রাফের সাংবাদিক লসাক তাঁর বইটি প্রকাশ করেন বিলেত ফিরে গিয়ে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আগেই।

গোটা পৃথিবী যাতে বাংলার মানুষের স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলনকে উগ্র-বিচ্ছিণ্ণতাবাদীদের আন্দোলনে রূপ না দিতে পারে সেজন্যই বঙ্গবন্ধু অপেক্ষা করেছিলেন সঠিক সময়ের। সিদ্দিক সালিক তাঁর "হুইটনেস টু স্যারেন্ডার"-এ লিখেছেন যে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সিনিয়র সহকর্মীর মাঝে গোঁপন বৈঠকের সময়ই নির্ধারিত হয়েছিলো যুদ্ধ বাঁধলে কয়টা সেক্টরে ভাগ হয়ে যুদ্ধ পরিচালিত হবে এবং কে হবেন যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক।

25 শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া বাঙালী জাতিকে ব্লাফ দিয়ে পালিয়ে যাবার পরই বঙ্গবন্ধু গোঁপন পরামর্শ মোতাবেক সিনিয়র নেতাদের ভারতে পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশনা দেন। অত:পর তিনি নায়ীম গওহর ও মোশাররফ হোসেনের মাধ্যমে টেলিফোন বার্তা পাঠান চট্টগ্রামে জহুর আহম্মদ ও এমআর সিদ্দিকের কছে। এর পরপরই বলধা গার্ডেন থেকে বাজানো হয় বঙ্গবন্ধুর "দিস মে বি মাই লাস্ট মেসেজ, ফ্রম টুডে বাঙলা দেশ ইজ ইন্ডিপেন্ডেন্ট..." এই অবিস্মরণীয় প্রি-রেকর্ডেড মেসেজটি। এই মেসেজটির কথা ইয়াহিয়া খান 26 মার্চ বেতার ভাষনে বলেছিলেন এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত শ্বেতপত্রেও উল্লেখ করা হয়।

একই ঘোষনার মেসেজ ইপিআর যখন পাঠাতে শুরু করে ততোক্ষণে 25 শে মাচের্র রাত শেষ হয়ে 26 শে মার্চ শুরু হয়ে গিয়েছিলো বলেই আমাদের স্বাধীনতা দিবস পালন করি 26 শে মার্চ।

রবার্ট পেইনের ম্যাসাকার অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু তখন আরেকটি যুদ্ধ ঘোষনার মেসেজ ডিকটেট করেন "পাক আর্মি সাডেনলী এট্যাক্ট ইপিআর বেইস এট পিলখানা এন্ড রাজারবাগ পুলিস লাইন, কিলিং সিটিজেন্স..."।

26 শে মার্চ দুপুরে প্রথম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় এম এ হান্নানের ভরাট কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা বার্তা। বেলাল মোহাম্মদের তত্ত্বাবধানে আবুল কাশেম সন্দীপ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার উল্লেখ করে সাধারণকে উদ্দীপ্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরণের বক্তব্য প্রচার করতে থাকেন।

এর মধ্যে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান ফোর্স নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে করতে পিছিয়ে পটিয়া চলে আসেন। তখন তাঁকে অনুরোধ করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাহারা বসানোর জন্য। মেজর জিয়া সে অনুরোধ সানন্দে গ্রহন করেন এবং 27 তারিখ সন্ধ্যায় তিনি বেতার কেন্দ্র পরিদর্শনে এলে বেলাল মোহাম্মদ তাঁকে অনুরোধ জানান যেন সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে তিনি একটি ঘোষনা দেন।

মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পরপর দুটি ঘোষনা পাঠ করেন যার দ্বিতীয়টি ছিলো এরকম, "আই, মেজর জিয়াউর রহমান ডু হেয়ারবাই ডিক্লেয়ার দ্যা ইনডিপেন্ডেস অফ বাংলাদেশ অন বিহাফ অফ আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লীডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...", বেলাল মোহাম্মদের "স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র" বইতে উল্লেখ আছে তা।

একথা ঠিক যে মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষনা সবচাইতে বেশী মানুষ শুনেছে এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে পলিটিশিয়ানদের সাথে সেনাবাহিনীও যোগ দিয়েছে যুদ্ধে- এই ঘোষনায় সর্বস্তরের মানুষের মাঝে তুমুল জাগরণ তৈরী হয়।

পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনার মেসেজ পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধুর প্রি-রেকর্ডেড সেই মেসেজটির মাধ্যমে। আর মাস পিপোলের কাছেই যদি মেসেজ পৌঁছানোর কথা বলি, তাহলে 7-ই মাচের্র সেই অবিস্মরণীয় ভাষনের কথা বলতে হয়।

আরো দলিল আছে, চাইলে আরও দেয়া যাবে। এখানে যতটুকু আপাতত দরকার, দিলাম এখানে-এবার আপনারাই ঠিক করুন, স্বাধীনতার ঘোষকের স্থানে কাকে বসানো যায়,
সিদ্ধান্ত আপনাদের...

---------------------

রেফারেন্স:

*পাকিস্তান ক্রাইসিস - ডেভিড লসাক
*হুইটনেস টু স্যারেন্ডার - সিদ্দিক সালিক
*আমেরিকান স্লট রিপোর্ট
*পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র
*ম্যাসাকার - রবার্ট পেইন
*স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র - বেলাল মোহাম্মদ
*বাহজাদ আহমেদ

No comments: